আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দুনিয়ায় আমেরিকান ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন হয়তো শেষ হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং ওয়াশিংটনে ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে অচলাবস্থা ডলারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে ডলার নিজের অবস্থান কতটা ধরে রাখতে পারবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক বছর যাবৎই ডলার বাদ দিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহার বাড়াতে বেশ কিছু দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পর এই প্রবণতা আরো বেড়ে যায়। অনেক দেশই বাণিজ্যিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। আফ্রিকার একাধিক দেশ সেই তালিকার নবতম সংযোজন।
আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে ইদানীং ডলার-বিমুখতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। মহাদেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্যের জন্য তারা আমেরিকান মুদ্রা ব্যবহারের পক্ষপাতী নয়। আফ্রিকার বাইরে অন্যত্রও অন্য মুদ্রা ব্যবহারের কথা চলছে।
ভারতে অবস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাসের তরফে সম্প্রতি ডলারের আধিপত্য বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে ডলার-বাণিজ্যের বিরোধিতা করেছেন ওই দেশের প্রতিনিধি।
কিছু দিন আগে ডলারের বিরুদ্ধ সুর শোনা গিয়েছে কেনিয়া থেকেও। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো অন্য আফ্রিকান নেতাদের মহাদেশের অভ্যন্তরে বাণিজ্যের জন্য ডলার ব্যবহার না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
সে ক্ষেত্রে বিকল্প হিসাবে প্যান-আফ্রিকান লেনদেন ব্যবস্থায় আস্থা রাখার কথা বলেছেন কেনিয়ান প্রেসিডেন্ট। এই ব্যবস্থা ২০২২ সালে চালু করা হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। এটি তাদের স্বতন্ত্র বাণিজ্যিক পদ্ধতি।
অবশ্য শুধু আফ্রিকা নয়, দক্ষিণ আমেরিকাতেও ডলার-বিরোধী প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে সম্প্রতি। ‘ডি-ডলারাইজেশন’কে সমর্থন করেছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দেশ।
‘ডি-ডলারাইজ়েশন’ এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আমেরিকার মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সিংহাসন থেকে সরিয়ে তার গুরুত্ব, মান কমিয়ে আনা যায়। এই প্রক্রিয়ায় সামিল হতে আগ্রহী অনেক দেশই।
চলতি বছরের এপ্রিলে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিয়ো লুলা দ্য সিলভা চিন সফরে গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি বিভিন্ন দেশকে ডলার বর্জন করে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারের ডাক দিয়েছেন।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ডলার না ব্যবহার করার চুক্তি হয়েছে ব্রাজিল এবং চিনের মধ্যে। তার পরেই ডলার ত্যাগের কথা অন্য দেশগুলিকেও বলেছেন ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট।
ডলারের বিরোধী হতে দেখা গিয়েছে আর এক দক্ষিণ আমেরিকান দেশ আর্জেন্টিনাকেও। তারা সম্প্রতি চিনের সঙ্গে বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে চিনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারে সম্মত হয়েছে।
জ়িম্বাবোয়েতে গত বছর চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাঝে ডলারের বিকল্প সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই দেশে সোনার মুদ্রা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
ডলারের চেয়ে জ়িম্বাবোয়ের মুদ্রার মান এক ধাক্কায় অনেকটা পড়ে গিয়েছিল। যার ফলে দেশে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। হু হু করে বেড়েছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে জ়িম্বাবোয়ে ডলারের বিকল্প হিসাবে নিয়ে আসে সোনার মুদ্রা। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে লড়াইয়ে তা কাজে লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও জ়িম্বাবোয়ের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
‘ডি-ডলারাইজেশনে’ পিছিয়ে নেই ভারতও। বিশ্বের মোট ১৮টি দেশে ‘স্পেশাল রুপি ভস্ত্রো অ্যাকাউন্ট’ বা এসআরভিএ খোলায় সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)।
এই দেশগুলি নিজ নিজ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারে আগ্রহ হারিয়েছে। ডলারের বিকল্প হিসাবে তারা ভারতীয় টাকায় উৎসাহ প্রকাশ করেছে। সুতরাং রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, বোৎসোয়ানা, জার্মানি, ব্রিটেন, ফিজি, গায়ানা, ইজ়রায়েল, কেনিয়ার মতো দেশ ভারতের সঙ্গে ভারতীয় টাকায় বাণিজ্য করবে।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার পাণ্ডে অবশ্য ডি-ডলারাইজেশনের এই ধারণাকে নতুন বলতে নারাজ। তিনি জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে অতীতেও ভারত রুবেলে (রাশিয়ান মুদ্রা) বাণিজ্যিক লেনদেন করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকা-সহ পশ্চিমের দেশগুলি পুতিনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য হোঁচট খায়।
তার পর থেকে ভারত এবং রাশিয়া পারস্পরিক বাণিজ্য করে থাকে রুবেল এবং ভারতীয় টাকার সাহায্যে। তবে চলতি বছরের মার্চ মাসে রাশিয়ার কিছু আপত্তিতে সেই ব্যবস্থা সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলিতে যে ডলারের শেয়ার ছিল ৭১ শতাংশ, তা বর্তমানে কমে এসেছে ৫৯ শতাংশে। ডলারের শেয়ার কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ইউরো এবং চিনা ইউয়ানের শেয়ার বৃদ্ধি।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, আমেরিকা বরাবর তাদের ডলারকে অন্য দেশগুলিকে দমিয়ে দেওয়ার অস্ত্র হিসাবে দেখে এসেছে। এই পন্থাই ডলারের পতনের সূচনা করেছে। আগামী দিনে ডলারের মূল্য, গুরুত্ব যত কমবে, তত অন্যদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে বলেও মনে করছেন তাঁরা।
বহু বছর ধরে, বিশ্বের অনেক দেশ ডলারকে ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল। এই নিষেধাজ্ঞার হাতিয়ারের সফল প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনতে প্ররোচিত করেছিল। এ ছাড়াও ডলার লেনদেনে মার্কিন ব্যাংকিং সেক্টরের একচ্ছত্র এখতিয়ার থাকায় অনেক দেশে বছরের পর বছর ধরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের রাশিয়ার ওপর সার্বিক নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকিয়ে দেয়ায় ডলারের আধিপত্যকে দুর্বল করার জন্য ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইন (ডিডিসি) প্রচেষ্টার পুনরুত্থান শুরু হয়েছে আগের চেয়ে আরো বেশি ক্ষোভের সাথে।
অতীতে বিক্ষিপ্তভাবে ইউরো, ইউয়ান ও রুবলের দ্বারা ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইনের ঝাঁকুনি দেয়া সত্তে¡ও ডলার তার বিশ্বব্যাপী আধিপত্যকে ধরে রাখতে পেরেছে। ইউরোর আবির্ভাব হয় ১৯৯৯ সালে। ইউরোজোনের ২০টি দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি একক মুদ্রা, দীর্ঘ প্রায় ২৩ বছরের প্রবল যুদ্ধের পর ডলারাইজড গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সির (জিআরসি) ২০ শতাংশ শেয়ার লাভ করতে পেরেছে।
চীনের ইউয়ান, কয়েক দশক ধরে ডলারের বিরুদ্ধে অবিরাম বিতর্কিত প্রচারণার পরে, ইয়েন (৫.২ শতাংশ) এবং পাউন্ড স্টার্লিং (৪.৯ শতাংশ) এবং জিআরসি মাত্র ৩ শতাংশ শেয়ার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
ইউরোর অপ্রতুল সাফল্যের কথা উল্লেখ করে, নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট মুণ্ডেল তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে, ইউরোজোনের দেশগুলোর একটি সমন্বিত সাধারণ মুদ্রাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, তাদের একই ধরনের ব্যবসায় চক্র, বিরোধহীন শ্রমব্যবস্থা ও পুঁজির গতিশীলতা এবং ঝুঁকি শেয়ার করার মেকানিজম থাকতে হবে।
গত ক’বছর ধরে ডলার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ডি-ডলারাইজেশন ক্যাম্পেইন (ডিডিসি) শুরু হয়েছে নতুন উদ্যমে, ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংক্ষিপ্ত রূপ) নেতৃত্বে। প্রশ্ন হলো- ব্রিকসের মাধ্যমে ডিডিসি প্রচেষ্টা কতটা সম্ভব এবং কত দ্রুত সফল হবে? তবে বিগত দিনের ডলার পতন আন্দোলনের ইতিহাসের ভিত্তিতে বলা যায়, ডলারের আধিপত্য এত তাড়াতাড়ি এবং এত সহজে পতন ঘটানো সহজ নাও হতে পারে। কারণ প্রথমত, ব্রিকস হলো এমন কিছু দেশের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা যার দেশগুলোর পরস্পরের সাথে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি।
দেশগুলো যেন মুক্তবাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদ, মিশ্র অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সাথে গণতন্ত্রী ও স্বৈরচারী কিছু দেশের একটি ককটেল। এই দেশগুলোর বেশির ভাগ তাদের নিজেদের মধ্যে যতটা না ব্যবসায় করে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের সাথে। চীন ও ভারতের বর্ডার নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী এবং বর্তমানে তা বহুগুণে বাড়ছে। রাশিয়া অর্থনৈতিক ও আর্থিকভাবে স্ব-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্রাজিল এক দশক পিছিয়ে পড়েছে; দক্ষিণ আফ্রিকা করোনা মহামারীর আগেও মন্দার খাদে আটকে গিয়েছিল।
এ ছাড়াও ডলারাইজড গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি (জিআরসি) হিসেবে কাজ করার জন্য যথেষ্ট কার্যকর মুদ্রা তৈরি করার জন্য ব্রিকস দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় স্তরের আস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। এমনকি চীনের রয়েছে অনেক ঘাটতি, যেমন- তাদের অর্থনীতি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো মুক্ত, লিক্যুইড ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত পুঁজিবাজার নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৮
আপনার মতামত জানানঃ