নিজেকে সুলতানা বলতে তিনি ছিলেন নারাজ। সুলতান হিসেবেই নিজের পরিচয় দিতেন তিনি। জুমার দিন তার নামে মসজিদে খুতবা পড়া হতো। কোনো নারী শাসকের নামে খুতবা পাঠ! ভারতের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম। ইতিহাস তাকে সুলতান রাজিয়া নামেই মনে রেখেছে। আজ থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে তিনি ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় রচনা করেন। তেরো শতকের শুরুর দিকে প্রথম ও একমাত্র নারী হিসেবে তিনি দিল্লি শাসন করেন।
সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের আদরের মেয়ে রাজিয়া। পিতার মৃত্যুর পর তিনি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ‘সুলতান রাজিয়াতুদ দুনিয়া ওয়াদ দিন’ উপাধি নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন তিনি। তবে তার সিংহাসনে আরোহণে অনেক বাধা ছিল। তার বৈমাত্রেয় ভাই মুয়িযউদ্দিন বাহরাম সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার ছিলেন। তৎকালীন মোল্লারাও তার সিংহাসনে আরোহণের বিরোধিতা করেছিলেন। সুলতান রাজিয়ার গুণ ও দক্ষতার কোনো কমতি ছিল না। তিনি একনিষ্ঠ, বিচক্ষণ, দক্ষ প্রশাসক ও যোগ্য সমরকুশলী ছিলেন। তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ ছিল না। তাকে নিয়ে বিরোধীদের একটিই আপত্তি ছিল। আর তা হলো তিনি ছিলেন একজন নারী!
সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের রক্ত তার শরীরে। হার মানার পাত্রী তিনি নন। সিংহাসনে আরোহণের পথে এসব বাধাকে থোড়াই পাত্তা দিলেন তিনি। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও প্রবল মনোবল নিয়ে তিনি সব বাধা দূর করেন। নিজের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে তিনি কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদে যেতেন। এটিকে উত্তর ভারতের প্রথম মসজিদ হিসেবে দাবি করা হয়। দিল্লির মেহরৌলিতে মসজিদটি অবস্থিত। তিনি সাধারণত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় মসজিদে যেতেন। সেখানে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে তিনি বক্তৃতা দিতেন। সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন চাইতেন তিনি। এর মাধ্যমে মসজিদে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য নারীদের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন সুলতান রাজিয়া। শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষে নারীদের মসজিদ নির্মাণেও তিনি পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন।
সুলতান রাজিয়া স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনি স্বাধীনভাবে ভ্রমণ করতেন। ঘোড়া ও হাতি চড়ায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করতে যেতেন। খানকা ও মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষকতায় তার নাম সুপরিচিত ছিল। তার পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এসব খানকা ও মাদ্রাসার মধ্যে অন্যতম ছিল মিনহাজ সিরাজ জুযজানির মাদ্রাসা। তিনি বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘তাবাকাত-ই-নাসিরি’র রচয়িতা। সুলতান রাজিয়ার অধীনে তিনি দিল্লির ‘শায়খুল ইসলাম’ ছিলেন।
মধ্যযুগে মুসলিম নারীদের এমন অনেক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। রাজনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মুসলিম শাসকরা তাদের সহধর্মিণী বা পরিবারের অন্য নারী সদস্যদের প্রতি আস্থা রাখতেন। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তার একটি চমৎকার উদাহরণ ছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুর। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি তার পত্নী, মা ও কন্যাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। কিংবদন্তি নারী নুরজাহানের ইতিহাসও তো কারো অজানা নয়। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ওপর এ গুণান্বিতা নারীর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। তেমনই আরেক নারী ছিলেন মাহাম আঙ্গা। তিনি মোগল শাসক জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের দুধমা।
ষোলো শতকে তিনি দিল্লিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করান। এটি খায়রুল মানাজিল মসজিদ নামে সারা ভারতে পরিচিত। ১৫৬১ সালে স্থাপিত মসজিদটি একজন নারী কর্তৃক নির্মিত দিল্লির প্রথম মসজিদ। রাজনীতিতেও তার মাথা ছিল পরিষ্কার। আকবরের রাজত্বের শুরুর দিকে তিনিই ছিলেন সাম্রাজ্যের প্রকৃত পথপ্রদর্শক। তখনো সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণে অনুপযুক্ত নাবালক আকবর। সে সময় নেপথ্যে থেকে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ার মাধ্যমে আকবরকে যাবতীয় ঝামেলা থেকে আগলে রেখেছিলেন মাহাম আঙ্গা। বুদ্ধি, পরামর্শ ও উপদেশের মাধ্যমে আকবরকে শাসনকার্যের ভার গ্রহণের উপযোগী করে তুলেছিলেন তিনি।
খায়রুল মানাজিল মসজিদে মাহাম আঙ্গার নামাজ পড়ার ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তার প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায় মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার দেখানো পথে অনেক মোগল রাজকুমারী হেঁটেছেন। তারা হয়তো নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাননি। কিন্তু পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তারা মসজিদ নির্মাণ করেছেন।
খায়রুল মানাজিল মসজিদের প্রধান খিলানে একটি শিলালিপি আছে। সেখানে মসজিদটির নির্মাতা হিসেবে মাহাম আঙ্গার নাম খোদাই করা আছে। মসজিদের পাশেই একটি মাদ্রাসা ছিল। মাদ্রাসাটিও মাহাম আঙ্গা তৈরি করেছিলেন। ইসলামী শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণে মুসলিম নারীদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন মাহাম আঙ্গা। তাকে অনুসরণ করে মোগল নারীরা অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা ও সরাইখানা নির্মাণ করেছেন।
বাংলা অঞ্চলেও অভিজাত নারীরা বহু মসজিদ নির্মাণ করেছেন। তারা সাধারণত বেগম বা বিবি নামে পরিচিত ছিলেন। ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদটির নির্মাতা এক মুসলিম নারী। তিনি বিনত বিবি নামে পরিচিত। তার নামেই মসজিদটি খ্যাতি পেয়েছে। মসজিদের শিলালিপিতে তার নাম হিসেবে ‘মুসাম্মাৎ বখত বিনত’ খোদাই করা আছে। ঢাকার নারিন্দায় অবস্থিত মসজিদটি পনেরো শতকে নির্মিত হয়। তেমনই আরেকটি বিখ্যাত মসজিদ হলো বাগেরহাটের চুনাখোলা গ্রামে অবস্থিত বিবি বেগনির মসজিদ। স্থানীয়দের মতে, বিবি বেগনি ছিলেন হজরত খান জাহান আলীর সহধর্মিণী। ষোড়শ শতকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদটি নির্মিত হয়।
ষাট গম্বুজ মসজিদের অনতিদূরে ঘোড়া দিঘির পাড়ে বিবি বেগনি মসজিদটি অবস্থিত। বিবি বেগনি নামে এক মুসলিম নারী মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে তার পরিচয় সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। কিন্তু স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে তিনি সুফি হজরত খানজাহান আলীর বিবি ছিলেন।
ইটের তৈরি সুদৃশ্য এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ। বাংলাপিডিয়ায় এ স্থাপত্যের বিবরণ দেয়া আছে। মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার আছে। মসজিদের বাইরে মিনারসহ প্রতি দিকের দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ১৫ মিটার। ভেতরে প্রতিটি দিকের দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক শূন্য ৫৮ মিটার। মসজিদের দেয়ালগুলো ৩ দশমিক শূন্য ৪৮ মিটার পুরু। এর পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলানাকার প্রবেশপথ আছে। মাঝের প্রবেশপথটি দুপাশের দুটি প্রবেশপথের তুলনায় বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে খিলানাকার প্রবেশপথ আছে। এ দুটি প্রবেশপথ ও পূর্বদিকের প্রবেশপথটি উচ্চতা ও প্রস্থে সমান। পশ্চিমের দেয়ালের ভেতর দিকে তিনটি মিহরাব আছে। এগুলো অর্ধবৃত্তাকার খিলানযুক্ত। মাঝখানের মেহরাবটি অন্য দুটির তুলনায় আকারে বড়। এটি দেয়ালের বহির্ভাগে আয়তাকারে বর্ধিত। মেহরাবের এ অভিক্ষেপ স্থানীয় অন্যান্য মসজিদ থেকে ভিন্নতর। দুই পাশের দুটি কোণের ওপর একটি করে বৃত্তাকার চূড়া আছে। মসজিদের ওপর একটি গম্বুজ আছে। চার কোণে আছে চারটি বৃত্তাকার বুরুজ। ছাদের কার্নিস বাঁকানো। বুরুজগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশের সীমা ছাড়িয়ে যায়নি। মেহরাব, খিলানপথ ও চার কোণের মিনারে টেরাকোটার নকশা করা। বর্তমানে এসব অলংকরণের অতি সামান্যই অবশিষ্ট আছে। এর মধ্যে শিকল নকশা, গোলাপ ও খাঁজকাটা খিলান উল্লেখযোগ্য। বিবি বেগনি মসজিদে তিনটি মিহরাব কুলুঙ্গি আছে। এগুলো মসজিদের স্থাপত্যে ভিন্ন তাত্পর্য যুক্ত করেছে। এ মসজিদে হজরত খানজাহান আলীর সময়কার স্থাপত্যরীতির ছাপ সুস্পষ্ট। মসজিদটি পনে শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয় বলে গবেষকদের অভিমত।
নারিন্দাতেই বিবি মেহের মসজিদ নামে আরেকটি মসজিদ আছে। ১৮১৪ সালে বিবি মেহের নামে এক অভিজাত মুসলিম নারী মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। নারায়ণগঞ্জের কিল্লারপুরে অবস্থিত বিবি মরিয়ম মসজিদটিও বেশ প্রসিদ্ধ। সুলতানি ও মোগল আমলের অনেক মসজিদ নারীদের নামাজ পড়ার উপযোগী করেই নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব মসজিদের নির্মাণশৈলী বিবেচনায় নিলে নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার বিষয়টা ধারণা করা যায়। উদাহরণ হিসেবে দিল্লির ওয়াজিরাবাদে অবস্থিত একটি মসজিদের কথা বলা যেতে পারে। এ মসজিদে সুদৃশ্য জালি দিয়ে ঘেরা চমৎকার একটি কক্ষ আছে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে ওয়াজিরাবাদ মসজিদের জালি দিয়ে ঘেরা অংশটি নারীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পুরুষেরা মসজিদের মূল অংশে নামাজ পড়তেন। আর নারীরা জাফরির পেছনে তাদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে নামাজ আদায় করতেন। বাংলা মুলুকের পাণ্ডুয়ায় অবস্থিত আদিনা মসজিদও এক্ষেত্রে চমৎকার একটি উদাহরণ। এটি ভারতের অন্যতম বড় মসজিদ। দিল্লির কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ থেকে এটি আকারে অনেক বড়। আদিনা মসজিদেও একই রকম জাফরি ঘেরা সংরক্ষিত কক্ষ আছে।
মধ্যযুগে ভারতের অনেক মসজিদে রাজকীয় ও অভিজাত নারীরা যেতেন। মসজিদ ও মাদ্রাসার পাশাপাশি নারীরা সুফিদের খানকা ও দরগায়ও যেতেন। সুফি কালামের আসরেও তারা ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে অংশগ্রহণ করতেন। তেরো শতকের গোড়ার দিকে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক মামলুক সাম্রাজ্যের ভিত স্থাপন করেন। তখন থেকে রাজকীয় ও অভিজাত মুসলিম নারীরা সুফিদের খানকাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। উনিশ শতক পর্যন্ত এ রীতি অব্যাহত ছিল। অনেক দরগা ও খানকায় মসজিদ ছিল। নারীরা সেখানে ঢুকতে পারতেন। তা নিয়ে সুফিদের কোনো কঠোরতা ছিল না। সূত্র: সিল্করুট।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ