পৃথিবীতে তামাকের অস্তিত্ব পাওয়া যায় প্রায় ৮০০০ বছর আগে। তবে ৬০০০ বছর আগে মধ্য আমেরিকায় শুরু হয় তামাকের চাষাবাদ। তারপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এর চাষ। কেননা প্রথম দিকে এটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
খীষ্টপূর্ব ১০০০ শতাব্দীর দিকে মায়ান সভ্যতার মানুষজন ধূমপান এবং তামাক পাতা চিবানো শুরু করে। মায়ান উপজাতির মানুষেরা তামাকের সঙ্গে আরো অনেক ভেষজ গাছ-গাছড়া মিশিয়ে অসুস্থ ও আহত মানুষের সেবা করতো। প্রাচীন গুহাচিত্র দেখে বোঝা যায় মায়ান পুরোহিতরা ধূমপান করতো।
মায়ান সম্প্রদায়ের লোকজন বিশ্বাস করতো ধূমপানের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। আস্তে আস্তে মায়ানরা সমগ্র আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে সাথে সাথে তাদের মাধ্যমেই তামাক গাছ সমগ্র আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে।
ইউরোপিয়ানদের মধ্যে সর্বপ্রথম তামাক গাছ আবিষ্কার করেন বিখ্যাত নাবিক ও আবিষ্কারক কলম্বাস। ১৪৪২ সালে তিনি যখন সান সালভাদরে গিয়ে পৌছান তখন সেখানকার লোকজন তাকে দেখে মনে করেন ঈশ্বর প্রেরিত স্বর্গীয় জীব। তারা তাকে খুশি করতে কাঠের তৈরি অস্ত্র, ফলমূল ও শুকনো তামাক উপহার দেন। কলম্বাস অন্য সবকিছু গ্রহন করলেও তামাক পাতাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে ফেলে দেন।
ঠিক ওই বছরই রডরিগো ডি জেরেয (Rodrigo De Jerez) কিউবায় আসেন এবং একদিন তামাক পাতা হঠাৎ পুড়ে গেলে সেখান থেকে আগত ধোঁয়া তার ভালো লাগতে শুরু করে। তার নিজেকে বেশ হালকা মনে হতে থাকে। এরপর তিনি তামাক পাতা মুড়িয়ে সেই ধোঁয়া টানা শুরু করেন।
ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ধূমপান করেন। তিনি ছিলেন স্প্যানিশ। ধূমপান করে তিনি সবাইকে চমকে দেন। একজন মানুষের নাক ও মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়া দেখে মানুষজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতেন। এমনকি এটাও ভাবা শুরু করেন যে তার মনে হয় কোনো আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে।
তাকে ধূমপানরত অবস্থায় অনেকেই দেখে মনে করতো তাকে ভূতে ধরেছে! এজন্য রডরিগোকে সাত বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়। জেলে বসেও তিনি অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে ধূমপান চালিয়ে যান। দিনে দিনে তামাকের চাহিদা বাড়তে থাকে। এভাবেই একসময় তৈরি হয় সিগারেট।
১৫৩০ সালের দিকের সময়ে ইউরোপিয়ানরা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বৃহৎ আকারে তামাক চাষ শুরু করে। উৎপাদিত তামাক আবার ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হতো। ১৫৭১ সালের সময়ে মোনার্দেস নামের একজন স্প্যানিশ ডাক্তার বিশ্বাস করতেন যে ধূমপান ৩৬ ধরনের অসুখ নিরাময় করে। যেমন: দাঁতের ব্যাথা, নখের প্রদাহ, সর্দি জ্বর এমনকি ক্যান্সার! তবে এটা শুধুই ছিলো তার একান্ত বিশ্বাস। এর বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৬০০ সালে স্যার ওয়াল্টার রিলি ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথকে ধূমপান করার একটা পাইপ উপহার স্বরুপ দেন। ধূমপান করার পর রানী অসুস্থ্ হয়ে পড়ে এবং তার চিকিৎসকরা মনে করেছিলো তাকে বিষ দেওয়া হয়েছে। এরপর স্যার রিলি আমেরিকায় ভার্জিনিয়ার গভর্নর রালফ লেনের মাধ্যমে পাইপের সঙ্গে পরিচিত হন এবং নিশ্চিত হন যে এটি বিষ নয়। তখনকার সময়ে ব্রিটিশ কলোনী ভার্জিনিয়া পুরা ইংল্যান্ডের জন্য তামাকের একটি উৎকৃষ্ট উৎস ছিলো।
১৬০৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস সর্ব প্রথম তামাকের ওপর উচ্চহারে ট্যাক্স আরোপ করেন। ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের লোকজন ধূমপানে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং ইংল্যান্ডে ব্যাপক আকারে তামাক আমদানী শুরু হয় কারণ সেই সময় মানুষ ভাবতো ধূমপান স্বাস্থ্যের উন্নতি করে!
১৬৬৫ সালে ইটন পাবলিক স্কুলে প্লেগ আক্রান্ত ছেলেদেরকে শক্তি বৃদ্ধির জন্য ধূমপান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো! এক ছাত্র ধূমপান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো, যার ফলস্বরুপ তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো! তামাক এবং পাইপের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবেই তামাক থেকে একসময় জন্ম হয় সিগারেটের। সিগারেট আস্তে আস্তে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে।
১৮১৫ সালের দিকে সিগারেট ধীরে ধীরে সব দেশেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি দি হাউস অফ পার্লামেন্টেও সিগারেট খাওয়ার জন্য আলাদা রুম রাখা হয়। ১৮২৮ সালে নিকোটিনের ভিতরে উপাদান কি আছে না আছে তা আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। কিছুদিনের মধ্যেই সবাই বুঝতে পারে এটি একটি মারাত্মক বিষ! যা ক্রমেই মানুষকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। ১৮৫২ এর সময় থেকেই ধূমপান করার সুবিধার্থে ম্যাচ বা দিয়াশলাই এর প্রচলন হয়।
১৮৫৬ সালে ক্রিমিয়ান যুদ্ধ ফেরত সৈন্যরা তুর্কি থেকে সিগারেট নিয়ে আসে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দশকের দিকে ইউরোপের দেশগুলো যখন পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত, তখন বেশ বড় একটি সমস্যাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আর তা হল ধূমপানে আসক্তি। সৈনিকদের মাঝে সিগারেট অনেক জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। অলসতা এবং বিষাদ দূর করার জন্য তখন সৈন্যদেরকে নিয়মিত সিগারেট সরবরাহ করা হতো।
সৈন্যরা মনে করতো ধূমপানের ফলে তাদের মধ্যে থেকে ক্লান্তি চলে যায়। সিগারেটের নিকোটিন কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্কের কোষকে অবদমন করতে পারে। আর নিকোটিনের মাত্রা কমে গেলেই মস্তিষ্কে এর চাহিদা শুরু হয়ে যায়।
যার ফলে সৈন্যদের মধ্যে দ্রুত সিগারেটের নেশা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখনকার সময়ে এর স্বাস্থ্যগত কুফল সম্পর্কে জানা না থাকলেও, সিগারেটের আগুনে কাঠের বাড়ি-ঘরগুলো পুড়ে যাওয়ার আশংকা সৈন্যদের মাঝে ছড়িয়ে যায়। তাই ধূমপান নিষিদ্ধকরণ আইন জারি করা হয় বেশ কিছু দেশে। আইন ভঙ্গকারীর জন্য কঠিন শাস্তিরও ব্যবস্থা করা হয়। কোনো কোনো দেশে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্তও বাদ যেত না। কিন্তু তামাকের জয়যাত্রা রোধ করা যায়নি তাতেও। অবশেষে তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটা আপোশে আসতে হয় কর্তৃপক্ষের৷ সরকারের জন্য এক্ষেত্রে তামাক খাতে পাওয়া করটাও কম লোভনীয় ছিলনা।
১৮৬৫ সালে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার ওয়াশিংটন ডিউক নামের এক ব্যাক্তি প্রথম সিগারেট রোল করে বিক্রি করা শুরু করে। ১৮৮৩ সালে জেমস বনস্যাক প্রথম সিগারেট রোল করার মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিন দিয়ে দিনে ১০০০ সিগারেট তৈরি করা যেত। বনস্যাক একটা সিগারেট কোম্পানী শুরু করেন যার নাম ছিলো আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী।
বনস্যাকের মেশিন সিগারেট শিল্পে বিপ্লবের সূচনা করে। তামাক চাষ এবং সিগারেট প্রস্তুত প্রক্রিয়ার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীতে বিশেষ করে জার্মানিতে নাৎসি শাসনামলে ধূমপানের আসক্তিটা মোটেই সুনজরে দেখা হতো না। সে জন্য ধূমপান বিরোধী নানা আইন কানুনও চালু হয় তখন। এর ফলে ধূমপান বাধাগ্রস্ত হয়।
১৯৩৯-১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তামাককে সংরক্ষিত শস্য হিসেবে ঘোষণা করেন। কারণ তখন সৈন্যরা এত বেশি ধূমপান করতো যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে তামাক সংকট দেখা দিয়েছিলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরোপের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আবার প্রয়োজন হয় তামাকের। আমেরিকা থেকে ৯০ হাজার টন তামাক আসে ইউরোপে। শক্তিশালী এক তামাক শিল্প গড়ে ওঠে জার্মানিতেও। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় আর্মিদের রেশনের সঙ্গে সিগারেটও যুক্ত করা হয়।
৭০-এর দশকে প্রথম ধূমপানবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে জার্মানিতে৷ ৯০-এর দশকে অধূমপায়ীদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়।
১৯৯৮ সালে জার্মান সংসদের নিম্নকক্ষে আনা ধূমপান বিরোধী একটি আইনের খসড়া প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায় তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বাভারিয়া রাজ্যের খ্রিস্টীয় সামাজিক দলের জেহোফারের প্রতিরোধে। জেহোফার তখন বাভারিয়ার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এখন আবার তিনিই ধূমপানবিরোধী কঠোর আইন কানুন প্রণয়নের ব্যাপারে সংসদে উচ্চকন্ঠ।
তার ভাষায়, ‘আমার কাছে যেটি বেশ সমস্যাজনক মনে হয়, তা হলো, কোনো কোনো রাজ্যে রেস্তোঁরার মালিকদের ওপরই ধূমপানের ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো রাজ্যে সব রকম রেস্তোঁরাতেই ধূমপান নিষিদ্ধকরণ আইন তৈরি হচ্ছে’।
প্রথম দিকে শুধু পুরুষরাই ধূমপান করলেও ১৯২৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে সিগারেটের প্রতি নারীরাও আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এই সময়ের দিকেই সিগারেট ব্যবসায়ীরা এর কেনা বেচাকে আরো বৃদ্ধির জন্য নতুন ভোক্তা খুঁজতে শুরু করে। একে ছড়িয়ে দেওয়ার উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে বিজ্ঞাপন এবং হলিউডের সিনেমার মাধ্যমে তারা নারীদেরকে সিগারেটের প্রতি আকৃষ্ট করে।
জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রজন্ম সিগারেটে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তখন সিগারেটের ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে কোনো সাবধান বাণীও প্রচার করা হতো না। ১৯০৮ সালে প্রথম শিশু আইনের কারণে ১৬ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের কাছে সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৪৭ এর দিকে সিগারেটের ট্যাক্স ৪৩% বৃদ্ধি করা হয়। মূল্য বৃদ্ধির ফলে ১৪% ব্রিটিশ নাগরিক ধূমপান ছেড়ে দেন।
সিগারেটের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছিলো। তাই এর ক্ষতিকারক দিক গুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রচারনা শুরু হয়। ১৯৫০ সালে সিগারেটের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে প্রথম প্রচারনা শুরু হয়। এই সময়ই আবিষ্কার হয় যে ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের মধ্য সম্পর্ক রয়েছে এবং এর অন্যতম একটি কারণ।
ড. ওয়াইন্ডার এবং ড. গ্রাহাম একটি গবেষনায় দেখান যে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ৯৫% মানুষই ২৫ বছর বা তার বেশি সময় ধরে ধূমপানে আসক্ত। স্যালফোর্ড নামের এক ব্যাক্তি প্রথম ধূমপান আসক্তি দূর করার জন্য প্রথম ক্লিনিক খোলেন।
১৯৬৪ সালে আমেরিকান ডাক্তাররাও অভিযোগ করেন ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। এর ফলে টিভি এবং রেডিওতে সিগারেটের প্রচারনা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়াও সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক কথা লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়।
সিগারেটের চাহিদা কমাতে লেটুসপাতা দিয়ে তৈরি এক প্রকার সিগারেট আবিষ্কার করা হয়। যেটা সম্পূর্ণভাবে নিকোটিনমুক্ত ছিলো। কিন্তু জনপ্রিয়তা লাভে ব্যর্থ। দি রেডিও টাইমস সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচারনা বন্ধ করে দেয়। ইউরোপ-আমেরিকায় পাবলিক পরিবহন এবং সিনেমা হলগুলো ধূমপান নিষিদ্ধ করে দেয়। ট্যাক্স বৃদ্ধির কারণে সিগারেটের দামও বেড়ে যায় যা সিগারেটের জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়।
১৯৮৪ সাল থেকে ইংল্যান্ডে জাতীয়ভাবে মার্চ মাসে নো স্মোকিং দিবস পালন শুরু হয়। ১৯৯২ সাল থেকে ধূমপানকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০০৩ সাল থেকে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বড় বড় করে ওয়ার্নিং লেখা শুরু হয়। যেমন: ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর! বা Smoking is highly addictive, don’t start!’
আয়ারল্যান্ড বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে জনসম্মুখে এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। এভাবেই ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য দেশও ধূমপান রোধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। বাংলাদেশেও প্রকাশ্য স্থানে ধূমপান করলে ৫০ টকা জরিমানাসহ বিভিন্ন আইন চালু রয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ