দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মুর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে৷ গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে সবসময়ই আতংকে থাকতে হয়৷
যে কোন দেশেই আইন তৈরি হয় জনগণের সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে৷ সুবিধার কথা মাথায় রেখে তৈরি আইনের কারণে যদি অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায়, তখন আবার আইনে পরিবর্তনও আসে, অনেক সময় তা বাতিলও হয়ে যায়৷ কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় এর উল্টা প্রবণতা৷ দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মুর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে৷
গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে সবসময়ই আতংকে থাকতে হয়, এই বুঝি তার উপর এই আইনের খড়গ নেমে এলো৷ এমনকি কিশোররাও হচ্ছে এর ভুক্তভোগী।
পরিসংখ্যান
একটি বেসরকারি হিসাব বলছে, সৈকতের মতো এ পর্যন্ত অন্তত ৬৮ জন শিশু কিশোরের ঘাড়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ ঝুলছে। তারা কেউ জামিনে আছে আবার কেউ কিশোর সংশোধনাগারে রয়েছে।
২০২০ থেকে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত ঢাকা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, বরগুনা, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, নওগাঁ, নড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, বরগুনা, দিনাজপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৬৮ শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩৪টি মামলা হয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক এই তথ্য জানিয়ে বলছে, মামলা হওয়া শিশুদের অধিকাংশই জামিনে আছেন। আবার অনেকে ১ থেকে দেড় বছর ধরে বিভিন্ন শিশু- কিশোর সংশোধনাগারে আছে। তবে মামলা এখনো চলমান আছে। যা আদালতে বিচারাধীন।
মামলা হওয়া শিশু-কিশোরদের অধিকাংশের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। কারও কারও মামলা হওয়ার সময় বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৪ বছর। আইনজীবীদের মতে, এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- বা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।
শিশুদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইন প্রয়োগ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন। ১৩ থেকে ১৭ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিরুদ্ধে ডিএসএ প্রয়োগের ফলে শিশু আইনের ব্যত্যয় ঘটছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানায় ২০ মামলা
২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলার ৬০ শতাংশই ধর্মীয় বিষয়কেন্দ্রিক। ফেসবুকে ‘কটূক্তি করা পোস্ট’ শেয়ার করায় ঢাকা, নওগাঁ, নড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, বগুড়া, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, বরগুনা, দিনাজপুরের ১৮ শিশু- কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ছয় জনের অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
তারা বলছেন, শিশুরা না বুঝে পোস্ট শেয়ার করে। ভুল বুঝতে পেরে পোস্ট ডিলেট করে ক্ষমাও চেয়েছে। তারপরেও মামলা থেকে রেহাই পাননি। অনেকে আর এমন ভুল করবে না, থানায় গিয়ে লিখিত দিতে চাইলেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে হওয়া অধিকাংশ মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব মামলা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট, কমেন্ট, শেয়ার ও স্টোরি দেয়ার কারণে হয়েছে। সবগুলো মামলাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারার প্রয়োগ করা হয়েছে।
২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী ও সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির অভিযোগে। আর বাকি ৬০ শতাংশ মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য।
ফেসবুকে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি নিয়ে কটূক্তি ছড়ানো, রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিয়ে কটূক্তি, সরকারের উন্নয়ন নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার, গুজব, ভীতি ছড়ানো, ব্যক্তির দুর্নীতির তথ্য প্রচার, ধর্ম অবমাননা, সরকারবিরোধী নানা লিঙ্ক শেয়ার ও কমেন্ট করা, এমনকি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জুয়া খেলার কারণে এসব মামলা হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য
এমনই এক ভুক্তভোগী পরিবার জানায়, ঘুম থেকে জেগে দেখি বাড়িতে পুলিশ। আমার ছেলেকে খুঁজছে। ভয়ে তখন গলা শুকিয়ে আসছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ ঘরে ঢুকে যায়। ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে সবার সামনেই হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। জানতে চাইলাম, আমার নাবালক ছেলের অপরাধ কী?
পুলিশ জানায়, সে ফেসবুকে কটূক্তি করে পোস্ট দিয়েছে। এ কারণে থানায় ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে। কথাগুলো বলছিলেন, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ১৫ বছরের কিশোর মনিরুল ইসলাম সৈকতের বাবা লুৎফর রহমান। মামলাটি হয় ২০২১ সালে। লুৎফর রহমান বলেন, করোনায় অনলাইনে ক্লাস করতে ছেলেকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিলাম।
কিন্তু সে নাকি ফেসবুকে ‘কটূক্তি করা পোস্ট’ শেয়ার করেছে। আমি এসব বুঝি না। ছেলে জেল থেকে ছাড়া পাইছে। এটাই বড় কথা। মামলা চলছে চলুক। একদিন সত্যের জয় হবে।
সৈকতের মামলায় আইনি সহায়তা করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট আব্দুল্লাহ আল নোমান। তিনি বলেন, সৈকতের অপরাধ ছিল, সে একটা ফেসবুক পেজে দেয়া ছবি শেয়ার করেছিল। এতেই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু এই অপরাধে একটি শিশুর বিরদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হতে পারে না। এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। আমরা তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে আবেদন করেছিলাম।
কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেনি। ইতিমধ্যে এ মামলার বিচার শুরু হয়েছে। মামলা হওয়ার সময় সৈকতের বয়স ছিল ১৫ বছর। সে তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। তবে এজাহারে তার বয়স ১৭ বছর লেখা হয়। নারী শিশু ট্রাইব্যুনালেই বিচার হচ্ছে। আমরা মামলা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছি। শুনানির অপেক্ষায় আছে।
২০২০ সালের ২১শে জুন ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ইমনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ইমন ও তার পরিবারের ভাষ্যানুযায়ী, মামলা ও অভিযোগের বিষয়ে তারা কেউ জানতেন না। ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পরদিন ২০২০ সালের ২০শে জুন বিকালে হঠাৎ করে সাধারণ পোশাক পরা পুলিশের তিন সদস্য ইমনের বাড়িতে এসে তার খোঁজ করতে থাকে।
ওই সময় ইমন বাড়িতে ছিল না। ইমনকে না পাওয়ায় পুলিশ চলে যায়। পরে ইমনের পরিবার জানতে পারে যে, ফেসবুক পোস্টের কারণে তার নামে থানায় মামলা হয়েছে।
ইমনের বাবা ইসমাইল হোসেন বলেন, ওইদিন তিনি ইমনকে সঙ্গে নিয়ে ভালুকা থানায় যান। ইমন থানায় ওসির কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে। ক্ষমাও চায়। তখন তাকে থানায় আটক রাখা হয়। ইমনের মা কান্নাকাটি করতে থাকলে, পরের দিন সকালে ছেড়ে দেয়া হবে বলে ওসি তাদের আশ্বাস দেন।
কিন্তু রাতেই ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়ে তাকে হাজতখানায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ইসমাইল আরও বলেন, ইমনকে আটক করার পর থানার হাজত রুমে তিন জন প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর সঙ্গে রাখা হয়েছিল। পরে আদালত থেকে জামিন পায়।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নবীনগরে ফেসবুকে একটি পোস্টে কমেন্ট করায় অভি চক্রবর্তী (১৬) নামে এক কিশোরকে আটক করে পুলিশ। অভির পরিবার জানান, একটা পোস্টে কমেন্ট করার পরে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখেই ভয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওই কমেন্ট ডিলেট করে অভি। এমনটি ভুল হয়েছে উল্লেখ করে ক্ষমা চেয়ে পোস্ট দেয়। তবুও মামলা থেকে রেহাই পায়নি। ২৫ দিন জেলেও থাকতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা চালানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জামিউল হক ফয়সাল মানবজমিনকে বলেছেন, ডিএসএ মামলার শিশুরা কেউই ঠিকমত নথিপত্র সই করতে পারে না। লেখাপড়ার চাপে অনেকে আবার আদালতে হাজিরা দিতেও আসতে পারে না। ফলে ভোগান্তির শেষ থাকে না। কারও কারও আদালতে ঘুরতে ঘুরতে লেখাপড়া শেষ হয়েছে। যারা এখনো স্বাধীন না।
মানবাধিকারকর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আসল অপরাধীরা পাহাড় কাটছেন, জলাভূমি দখল করছেন, বন উজাড় করছেন, বালু তুলছেন, তাদের কিছু হচ্ছে না। ফেসবুকে সমালোচনা করে এক লাইন লিখলেই কারাবরণ করতে হচ্ছে। শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। আমার মাথায় ধরে না শিশুরা অপরাধ করলে শিশু আইন আছে। সেই আইনে বিচার হতে পারে। ডিএসএ শিশুদের ঘাড়ে চাপানো হবে কেন?। যে আইনের ধকল বড়রাই নিতে পরে না। সেখানে শিশুরা নিবে কীভাবে? এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত।
এসডব্লিউ এসএস /২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ