সৌরভ বা সুগন্ধি নানান কাজে ব্যবহৃত হলেও নারী-পুরুষ একে অপরকে আকর্ষণ করতে সুগন্ধির ব্যবহার হলো এর আদি ও প্রধান কাজ। নারী পুরুষ উভয়, উভয়কে আকৃষ্ট করতে সুগন্ধির সাহায্য নিয়েছে বহুবার। এটি শুরু হয় মূলত মধ্যযুগের দিকে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ‘নারীর চেয়ে পুরুষরাই যুগে যুগে সুগন্ধির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি করেছে। তবুও দেখা যায় সুগন্ধি সাবান থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের সুগন্ধির বিজ্ঞাপনচিত্রে নারীকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটা কেন? সে প্রশ্ন অনেকের।
আসলে সবাই তার চারপাশে মোহাচ্ছন্নর মতো ছড়িয়ে থাকা এক সুবাসিত পরিবেশ খোঁজেন। শহর ছাড়িয়ে বিশুদ্ধ বাতাসে প্রকৃতি যে সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয় তা বুক ভরে টেনে নেওয়ার মধ্যে রয়েছে ভিন্ন এক রকম স্বাদ। আবার প্রিয়জন যখন খোঁপা খুলে এলো চুলগুলো ছড়িয়ে দেয়, সেখানেও কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে এক দুষ্টু-মিষ্টি আবেশীয় প্রেমের গন্ধ, ফেরোমনের গন্ধ।
প্রেম ভালোবাসা আর যুদ্ধের সঙ্গে সুগন্ধির সম্পর্ক বেশ নিবিড়। শেক্সপিয়ার, অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রার প্রেম অভিসারের কথায় বারবার এসেছে সুগন্ধি। ক্লিওপেট্রার নৌকা যখন নীল নদে ভেসে যাচ্ছিল তখন বাতাস দারুণ সুরভিতে আমোদিত হয়ে উঠেছিল। আবার নেপোলিয়ন যুদ্ধে যেতেন বিভিন্ন সুগন্ধি নিয়ে। এটি নাকি তার ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতো আর উৎসাহ যোগাত যুদ্ধে।
আবার ‘পারফিউম কিং’ নামে পরিচিত ছিলেন ফরাসি সম্রাট চর্তুদশ লুই। সুগন্ধ বিলাসী রাজা চর্তুদশ লুইয়ের উদ্যোগে ১৬৯৬ সালে সে সময়ের বিভিন্ন পারফিউমের নাম লিপিবদ্ধ করা হয় এক বইতে। তার রাজ্যসভার পরিষদবর্গের পারফিউম আদিখ্যেতায় বিরক্ত হয়ে পশ্চিমা সাহিত্যের সেরা হাস্য-রসাত্মক লেখক মলিয়ের ‘পারসিউসেস রিডিকিউলস’ নামে একটি ব্যাঙ্গাত্মক নাটকই লিখে ফেলেন।
চর্তুদশ লুইয়ের শাসনামলে ফ্রান্সে এবং ইউরোপের অন্যান্য শ্রেণির লোকরা ছাগলের দুধে গোলাপের পাপড়ি ফেলে তাতে গোসল করতো এবং প্রচুর সুগন্ধি গায়ে মাখতো। এছাড়া অভিজাত শ্রেণির মানুষেরা বাড়িতে কোনো উৎসব, পার্বণ বা অনুষ্ঠান হলে পায়রা কিংবা অন্য কোনো পাখিদের সুগন্ধির তরলে ভিজিয়ে উড়িয়ে দিতো বিশাল হল ঘরে। আর এতেই সুন্দর স্নিগ্ধ গন্ধে ভরে উঠতো হল ঘর।
তবে আঠেরো শতকের মধ্যভাগ থেকে সৌরভের সংক্রমণ অভিজাতদের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং মধ্যবিত্তদের মাঝেও সুগন্ধ ধূপের প্রচলন শুরু হয়ে যায়। ইউরোপীয় সমাজবিজ্ঞানীদের মতে ১২০০ শতকে ইউরোপে প্রথম সুগন্ধির প্রবেশ ঘটে।
গবেষকদের মতে, মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতো সুগন্ধি ব্যবহারের ইতিহাসও অতি প্রাচীন। অতীতে মৃত ব্যক্তির আত্মার সৎকার, শ্রদ্ধাঞ্জলিতে ব্যবহৃত হতো নানারকম সুগন্ধি। দেহের নানান রকম অসুখে ব্যবহার করা হতো সুগন্ধি মলম। এছাড়া অনেক গাছ গাছড়া, ফল, ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি সুগন্ধি নানারকম কীট-পতঙ্গ সাপ বিতাড়িত করতো বলেও জানা যায়।
জীব বিজ্ঞানীদের মতে, আগুনের ব্যবহার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ উপলব্ধি করে যে গাছ, লতা, পাতা প্রভৃতি নির্যাসের ধোঁয়ার কীট-পতঙ্গ বিতাড়িত হয় খুব সহজেই। সে থেকেই প্রধানত সুগন্ধির ব্যবহার শুরু। রসায়ন বিজ্ঞান আবিষ্কারের বহু আগেই সুগন্ধির প্রচলন শুরু হয়। সুদূর অতীতে নানারকম গাছ-গাছড়ার নির্যাস থেকে সুগন্ধি তৈরি হতো। গবেষকরা মনে করেন বিভিন্ন নির্যাস নিয়ে ঔষধ তৈরির প্রচলনের সেই আদিযুগেই সুগন্ধির আবিষ্কার হয়। আর তখন থেকেই নিত্য নতুন নানান রকম সুগন্ধি আবিষ্কৃত হয়ে আসছে।
বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে, শুভ কাজে, দেবতাদের পূজায়, সুগন্ধি ব্যবহার এখন যেমন রয়েছে তেমনি অতীতেও ছিল। প্রাচীন মিশরে একেকজন দেবতার পূজা হতো ভিন্ন ভিন্ন সুগন্ধি দিয়ে। আবার প্রাচীন বিশ্বভারতে পূজার একটি অপরিহার্য বস্তু ছিল চন্দন কাঠ। এছাড়া কয়েকটি গাছের নির্যাসও পোড়ানো হতো। যাতে পূজার স্থানটি ভরে যেতো সৌরভে।
ঐতিহাসিকদের মতে-গ্রীক, রোমান, আরব, অ্যাজটেক, কার্থেজিয়ান থেকে শুরু করে সুপ্রাচীন সভ্যতায় সুগন্ধির ব্যবহার ছিল। চৈনিক সভ্যতায় নানান ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার হতো। যেমন মিশরে মমি করে কফিন আটকানোর পরে কয়েক ধরনের সুগন্ধি বেশ কয়েকবার করে মাখিয়ে নেওয়া হতো।
সুগন্ধির শুরুটা যেভাবেই হোক, ধীরে ধীরে তা বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত হতে থাকে। ব্যবহারিক দিক থেকে তো বটেই, উৎপাদনের উৎস ভেদেও সুগন্ধির রয়েছে নানান বিভাজন। যেমন-ফ্লোরাল গ্রুপ: ফুলের গন্ধযুক্ত যেসব পারফিউম রয়েছে সেগুলো ফ্লোরাল গ্রুপের অর্ন্তগত। জেসমিন, বেলী, জুঁই, গোলাপ, লিলি-অব-দ্য-ভ্যালি, লাইল্যাক, কারনেশন, গার্ডিনিয়া, হায়াসিন্থ, নার্সিসাস, কমলালেবুর ফুলের সুগন্ধ এর মধ্যে জনপ্রিয়।
হার্বাল সুগন্ধির মধ্যে রয়েছে টাটকা খড়, ঘাস, অর্কিড ইত্যাদির ছোঁয়া। ফলে খুব সহজেই এগুলো চেনা যায়। লেদার টোবাকো সুগন্ধিকে ছোটই বলা চলে। কারণ এতে রয়েছে চামড়া, তামাক এবং ধোঁয়ার গন্ধযুক্ত পারফিউম। স্পাইসি ব্লেন্ডস: এটাকে মসলা বিভাগের বলা যেতে পারে। কারণ এতে রয়েছে কারনেশন, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচ, এলাচ, ক্যারাওয়ে, বেসিল প্রভৃতি মসলার গন্ধযুক্ত সুগন্ধ।
উডি ফ্যামিলি; এক সময়ের বিখ্যাত ‘ইন্টিমেট’ ছিল এই উডি পারফিউম। চন্দন কাঠ, সিডার কাঠ, গুইয়াক কাঠ প্রভৃতির সুগন্ধি থেকে তৈরি হয় এই পারফিউম। ওরিয়েন্টাল ফ্যামিলি: এটা অনেকটা মিশ্রজাতের পারফিউম। এতে উডি, মসি এবং স্পাইসি নোটের সঙ্গে মিশেছে ভ্যানিলা ও বালসামের মিষ্টত্ব। ওরিয়েন্টাল নোটটিকে ফুটিয়ে তুলতে মাস্ক, সিভেট বা অ্যাম্বার নোট ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অ্যালডিহাইডিক গ্রুপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের পারফিউম। কারণ এসব পারফিউমের সুগন্ধ প্রকৃতিজাত নয়।
সুগন্ধি প্রেমিকদের জানা থাকা দরকার, সুগন্ধির কিন্তু খারাপ দিকও রয়েছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, মাত্রাতিরিক্ত সুগন্ধি ব্যবহারে আপনার ঘ্রাণশক্তি কমে যেতে পারে। সুগন্ধি নিজেকে আকর্ষণীয় করার জন্য হলেও সময় আর অবস্থা ভেবে এর ভুল ব্যবহারে এটি বিকর্ষণের কারণও হয়ে উঠতে পারে।
যেমন ধরা যাক, আপনি যাচ্ছেন কোনো শোক সভায়, সেক্ষেত্রে যদি এইক্স ভুডো কিংবা ডেনিম ব্যবহার করে যান তবে পুরো অনুষ্ঠানের মানুষের কাছে আপনি হবেন বিরক্তিকর। তেমনি ভালোবাসার মানুষের বার্থডে পার্টিতে যদি কানে এক টুকরো আতর ভেজা তুলো গুজে দেওয়া হয় সেটিও খুব কাজের কিছু হবে না। অতএব সবরকম সুগন্ধি ব্যবহারে একটু সতর্ক থাকতে হবে।
এসডব্লিউএসএস/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ