পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৩০তম বিসিএসের কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলামের নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বর্তমান সময়ে মন্ত্রণালয়টির সকল কর্মকর্তার আলোচনার অন্যতম একটি বিষয় হলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে সম্প্রতি পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সৎ ও পেশাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক হতাশার সঞ্চার করেছে। অনেকেই বলেছেন যে ব্যাপক আর্থিক দূর্নীতির কারণে এই কর্মকর্তার অনেক আগেই চাকুরী চলে যাওয়া উচিত ছিল। তাদের মতে, যার জেলে থাকার কথা সেই কর্মকর্তার কোনরকম শাস্তি না হয়ে উল্টো পদোন্নতি প্রদানের বিষয়টি রীতিমত বিস্ময়কর।
চাকুরী জীবনের শুরুতে প্রটোকল উইং এ কর্মরত থাকা অবস্থাতেই দিনাজপুরের এই কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলামের নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। তখন প্রটোকল উইং থেকে তাকে বের করে দিয়ে ওআইসি-সিএফএম আয়োজনের কাজে সংযুক্ত করা হয়। সেখানেও বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়ার গুঞ্জন উঠে তার বিরুদ্ধে।
পরবর্তিতে ওয়াশিংটন দূতাবাসে পোস্টিং নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও কোন এক অদৃশ্য কারণে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী এই মাহমুদ। তার সমসাময়িক বুয়েট ছাত্রদের কাছ থেকে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ক্ষমতাসীন ছাত্রদলের বুয়েট এবং হল শাখার নেতাদের বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবেই সুপরিচিত ছিলেন।
মাহমুদুল ইসলামের দুর্নীতির কিছু খতিয়ান
দূতাবাসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ৯৮,০০০ ডলার আত্মসাৎ:
ওয়াশিংটন দূতাবাসের নামে দীর্ঘদিন ফ্রিজ হয়ে থাকা সিটিব্যাংক-এর একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ৯৮ হাজার ডলার দূতাবাসের রেগুলার অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যাংক কতৃপক্ষ ডিডিও মাহমুদুল ইসলামকে জানালে তিনি তার সকল অপকর্মের প্রধান সহযোগী হিসাবরক্ষক রবিউল ইসলামের সাথে যোগসাজশে নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ৫০,০০০ ডলার এবং রবিউল ইসলামের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ৪৮,০০০ ডলার সরিয়ে নেন। তিনি মনে করেছিলেন, দীর্ঘদিন ফ্রিজ থাকা এই অ্যাকাউন্টের কথা যেহেতু পূর্বতন রাষ্ট্রদূতগণ জানতেন না, সেহেতু এই অ্যাকাউন্টের টাকা নিজেদের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে আত্মসাত করলেও কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু দূতাবাসের একাউন্ট থেকে এইরূপ বড় পরিমান টাকা ব্যাক্তিগত একাউন্টে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সিটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অস্বাভাবিক লেনদেন হিসেবে সনাক্ত করে তদানীন্তন রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করেন বিধায় বিষয়টি কিছুটা জানাজানি হয়ে যায়। যদিও কোন এক রহস্যজনক কারণে পরবর্তিতে তা ধামাচাপা দেওয়া হয়।
ওয়াশিংটন ডিসিতে ভিভিআইপি ভ্রমণকালে গাড়ি ভাড়া থেকে ৭০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ:
২০২১ ও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে প্রতিনিধিদল নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসি ভ্রমণ করেন। নিউইয়র্ক ভ্রমণ আয়োজনের দায়িত্বে ছিল নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন আর ওয়াশিংটন ডিসি ভ্রমণের আয়োজন করে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস। এটি সর্বজনবিদিত যে, নিউইয়র্ক ওয়াশিংটন ডিসির তুলনায় বেশি ব্যায়বহুল। জাতিসংঘের অধিবেশনকালে এই ব্যয়ের অনুপাত আরো অনেক বেড়ে যায়। অথচ ২০২১ সালে গাড়ি ভাড়া বাবদ নিউইয়র্ক এর তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি ব্যয় দেখিয়ে তিনি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক মিশন বিদেশি কোম্পানি থেকে গাড়ি ভাড়া করে। অন্যদিকে মাহমুদুল ইসলাম কতিপয় বাংলাদেশি অসাধু ব্যাক্তির সাথে যোগসাজশ করে নামসর্বস্ব কোম্পানি থেকে গাড়ি ভাড়া করে উক্ত ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০২২ সালের ভিভিআইপি ভ্রমনকালেও তিনি একই কোটেশন দাখিল করে অর্থ আত্মসাতের পায়তারা করেছিলেন যা মন্ত্রনালয়ের সতর্ক অবস্থানের কারনে ব্যর্থ হয়। গাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত ২০২১ সালের দুর্নীতি চিহ্ণিত হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় মাহমুদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
ওয়াশিংটন দূতাবাসের ভবন ও গাড়ি মেইনটেন্যান্সের টাকা হরিলুট:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা হচ্ছে, আর্থিক শৃংখলা ও স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে হেড অব চ্যান্সারি এবং ডিডিও এর দায়িত্ব যাতে ভিন্ন দুই কর্মকর্তার মধ্যে বন্টন করা হয়। ওয়াশিংটন দূতাবাসে অধিক কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও মাহমুদুল ইসলাম তার পুকুরচুরির সুবিধার্থে সিনিয়রদের ম্যানেজ করে একাই দূতাবাসের হেড অব চ্যান্সারি এবং ডিডিও এর দায়িত্ব পালন করেন তার পোস্টিং এর পুরোটা সময়। এই অবস্থায়, দূতাবাসের নিজস্ব ভবন মেইনটেন্যান্স ও গাড়ি মেরামতের নামে অসংখ্য ভুয়া ভাউচার তৈরী করে বিগত চার বছরে কয়েক কোটি টাকা পুকুর চুরি করেছেন। তার এ সকল চুরির স্বার্থে দূতাবাসের মেইনটেন্যান্স কর্মকর্তা রাজিব আহমেদসহ আরো কয়েকজন স্টাফকে সাথে নিয়ে দুর্নীতির একটি মহা সিন্ডিকেট গঠন করেন।
এছাড়াও ওয়াশিংটন দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত ভ্রমনকে সরকারী কাজে সফর দেখিয়ে টিএ/ডিএসহ পরিবারের সদস্যদের বিমান ভাড়ার টাকা সরকারী তহবিল থেকে নেওয়া তার কাছে একটি নৈমিত্তিক ঘটনা মাত্র। তার বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে দূতাবাসের কর্মচারী হিসেবে দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মানব পাচার করে নিয়ে আসা। হেড অব চ্যান্সারি এবং ডিডিও-এই দুই দায়িত্ব এককভাবে পালন করার সুবিধা নিয়ে তিনি অবলীলায় এসকল দুর্নীতি চালিয়ে গেছেন।
বাসাভাড়া বাবদ ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ:
মাহমুদুল ইসলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত থাকাকালে দূতাবাসের কাছাকাছি একটি ভবনের ফ্ল্যাটে বাস করেছেন চার বছরের অধিক সময়। বাসাটির ভাড়া বর্তমানে ৩২০০ ডলার হলেও পূর্বে তা ছিল ২৮০০ ডলার। শুরুতে ৩৭০০ এবং সর্বশেষ ৪৫০০ ডলার বাসা ভাড়া দেখিয়ে দূতাবাসের একমাত্র কর্মকর্তা হিসেবে মাহমুদুল নিজ নামে বাসাভাড়ার চেক নিয়েছেন ৪ বছর ধরে। কোভিড চলাকালে ওয়াশিংটন ডিসিতে আইন করে বাসা ভাড়া বৃদ্ধি বন্ধ রাখা হলেও প্রতি বছর তিনি ৫ শতাংশ হারে বাসা ভাড়া বৃদ্ধি করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হল, সরকারী বিধান অনুযায়ী দূতাবাসের সকল কর্মকর্তার বাড়িভাড়া দুতাবাস হতে সরাসরি বাড়ির মালিক/ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চেক মারফৎ প্রেরণ করা হলেও ডিডিও হিসেবে চেক স্বাক্ষরের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি বাড়ি ভাড়ার চেক নিজ নামে ইস্যু করে ৪ বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন।
স্ট্যান্ড রিলিজকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে এক বছরের অধিক কাল অবস্থান:
মাহমুদুল ইসলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে ৩ বছর দায়িত্ব পালনের পর তাকে মুম্বাইতে বদলী করা হয়। তিনি কোন রকম কারণ ব্যাতিরেকেই বদলী আদেশ অমান্য করে ওয়াশিংটন ডিসিতে চাকুরি চালিয়ে যান। ঐদিকে মুম্বাই মিশনের মিশন প্রধান বাদে একমাত্র কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে দিল্লী মিশনের কর্মকর্তা এনে লক্ষ লক্ষ টাকা টিএ ডিএ খরচ করে মিশনটি সচল রাখা হয়। এটি সুস্পষ্ট যে দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্টে থাকা মাহমুদ পুকুর চুরির সুযোগগুলো হাতছাড়া করতে চাননি বলেই মুম্বাই মিশনে যোগদানে গড়িমসি করতে থাকেন। অবশেষে তাকে শাস্তিমূলক স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। মজার বিষয় হলো স্ট্যান্ড রিলিজ আদেশকেও তিনি বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে ওয়াশিংটন অবস্থান করতে থাকেন। অবশেষে দ্বিতীয়বার স্ট্যান্ড-রিলিজ করা হলে তিনি নিতান্তই গলাধাক্কার মুখে ওয়াশিংটন ত্যাগ করেন। মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ড-রিলিজ আদেশ অমান্য করা গুরুতর অন্যায় হলেও মাহমুদের অন্যসব অপরাধের মত এটিকেও উপেক্ষা করা হয়েছে।
আর্থিক সততা এবং স্বচ্ছতার জন্য পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সুনাম থাকলেও তাদের পাশ কাটিয়ে দুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এই কর্মকর্তা ওয়াশিংটন ডিসির মত গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসে কিভাবে পদায়িত হলেন তাও সকলের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার সহকর্মীদের কেউ কেউ মনে করেন, একজন জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে মাহমুদুল ইসলামের দুর্নীতির যে চিত্র পাওয়া গিয়েছে তাতে তিনি যখন রাষ্ট্রদূত হবেন তখন তিনি নিজের স্বার্থে দেশ বিক্রি করে দিতেও কুন্ঠিত হবেন না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ খুবই গুরুতর। তদন্ত করে তার শাস্তির ব্যবস্থা করে কূটনৈতিক অঙ্গনে বিচার ও শাস্তিহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটানো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তা হবে কূটনীতিকদের অপকর্মকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহ দেওয়ারই নামান্তর।
আপনার মতামত জানানঃ