করোনাভাইরাস ছিল ২০২০ সালের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। তবে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া এ বছরও বিশ্ববাসীর পরীক্ষা নিয়েছে। বছরজুড়ে সবাইকে ভুগিয়েছে বৈরি আবহাওয়া সৃষ্ট বিপর্যয়জনিত নানা দুর্যোগ। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্ববাসীকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বন্যা সবচেয়ে মারাত্মক চেহারা ধারণ করেছিল।
বিশ্বের অনেক দেশ এ বছর বন্যা দেখেছে। বাংলাদেশেও ঘূর্ণিঝড় আমফান ও পাঁচ দফায় সৃষ্ট বন্যা দেশবাসীকে ব্যাপকহারে ভুগিয়েছে। পাঁচ দফার বন্যায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল। তবে বন্যা আক্রান্ত করেছে বাংলাদেশের পাশাপাশি চীন, ভারত, নেপালের এমনসব অঞ্চলকে, যেখানে ১০০ কোটির বেশি মানুষের বাস। বছরজুড়ে এই ১০০ কোটি মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে লড়তে হয়েছে বন্যার সঙ্গে। আর এসব দেশে বাস করা ৪০০ কোটি মানুষকে কোনো না কোনোভাবে বন্যার ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে।
দাতব্য সংস্থা ‘ক্রিশ্চিয়ান এইড’-এর তৈরি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছয়টিই ঘটেছে এশিয়া মহাদেশে। চীন ও ভারতে বন্যায় ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এশিয়া মহাদেশে বর্ষাকালে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। মূলত সমুদ্র থেকে ভূখণ্ডে উঠে আসা নানা ঘূর্ণিঝড় সঙ্গে করে প্রচুর মেঘ নিয়ে আসায় অস্বাভাবিক বৃষ্টি এবং তা থেকে বন্যা দেখা দিয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, কয়েক মাসের টানা বন্যায় ভারতে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কয়েক লাখ মানুষ। অর্থের হিসাবে যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তথ্য উপাত্তের ঘাটতি না থাকলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্যাও এ বছরের মহাবিপর্যয়ের তালিকায় স্থান পেত বলে মনে করেন স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা।
এশিয়ার আরেক দেশ চীনেও বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্যায় দেশটিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। তবে সেখানে প্রাণহানি ভারতের তুলনায় কম হয়েছে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ে। কিন্তু কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে যেটা মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিওরোলোজির জলবায়ুবিজ্ঞানী ড. রক্সি ম্যাথু কল বলেন, আমরা এ বছর আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে রেকর্ড তাপমাত্রা দেখতে পেয়েছি। এই উচ্চ তাপমাত্রার কারণেই সমুদ্রের তাপীয় তরঙ্গের বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এসেছে এবং অকালে আম্পান ও নিসর্গর মতো ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলোর অন্যতম ছিল আম্পান।
ইউরোপের দেশগুলোও এ বছর ঝড়ে নাকাল হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতেই ঝড় কিয়ারার কবলে পড়ে আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশ। এই ঝড়ে অন্তত ১৪ জনের প্রাণহানি ছাড়াও ২৭০ কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বছরের শেষে এসে যুক্তরাজ্য পড়েছে শক্তিশালী আরেক ঝড় বেলার কবলে। এ ঝড়ের প্রভাবে ভারী বৃষ্টির কারণে এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে বহু এলাকা; বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, যান চলাচল বিঘ্নিত হয়ে লোকজন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর রেকর্ড সংখ্যায় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। সে সঙ্গে দাবানলের কারণে দেশটিতে ক্ষয়ক্ষতির মোট আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
আফ্রিকাতেও হানা দিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেখানে কয়েকটি দেশে বছরের শুরুর দিকে পঙ্গপাল হানা দেয়। বিশালাকৃতির ওই পঙ্গপালের ঝাঁক মাইলের পর মাইল ক্ষেতের ফসল খেয়ে শেষ করে দেয়। পঙ্গপালের কারণে সেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলার। মধ্যপ্রাচ্য এবং হর্ন অব আফ্রিকাখ্যাত ইথিওপিয়াসহ ওই অঞ্চলে অসময়ে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ওই পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল।
গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকার কারণে সামনের দিনগুলোতে আবহাওয়া আরও চরমভাবাপন্ন হয়ে পড়বে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও শক্তিশালী রূপ নিয়ে মানুষের ওপর আঘাত হানবে। দেশে দেশে তাই পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার জন্য উপযোগী কর্মকৌশল গ্রহণ করা দরকার।
আপনার মতামত জানানঃ