রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায়, যার বাইরে নেই বাংলাদেশও। নেতিবাচক ধারা দেখা গিয়েছে রফতানি ও রেমিট্যান্সে। বেড়ে গিয়েছে ডলারের বিনিময় মূল্য। ব্যাংকগুলোয় দেখা দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, যা আরো ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভারতমুখিতা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে গত অর্থবছরে ব্যয় বেড়েছে ৫৯ শতাংশের বেশি। চলতি বছরও খাদ্যশস্য, কাঁচামাল ও বিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে ব্যয় আরো বাড়ার প্রবণতায় রয়েছে। এদিকে গতকাল আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখাসহ বাণিজ্য জোরদারে ভারত সফরে গিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শিল্প খাতের কাঁচামালের জন্য অনেকাংশে আগে থেকেই ভারতনির্ভর ছিল বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে ভারতের ওপর এ নির্ভরতা এখন আরো বাড়ছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ভারত থেকে আমদানি বাবদ বিপুল পরিমাণ ব্যয় হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ছিল ১ হাজার ৩৫৯ কোটি ডলার। আমদানিতে মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় ছয় ধরনের পণ্যে। এ ছয় ধরনের পণ্যের মধ্যে রয়েছে তুলা, সিরিয়াল (খাদ্যশস্য), মোটরযান ও যানবাহনের যন্ত্রাংশ, চিনি, খনিজ পণ্য ও জ্বালানি, যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, ইস্পাত ও রাসায়নিক।
অর্থমূল্য বিবেচনায় ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় তুলা। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয়ের ৩০ দশমিক ৮ শতাংশই হয়েছে তুলা আমদানিতে। পণ্যটি আমদানিতে ব্যয়ের অর্থমূল্য ছিল ৪২১ কোটি ৮১ লাখ ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ১১১ শতাংশেরও বেশি। আমদানি ব্যয় বিবেচনায় ভারত থেকে আমদানি করা দ্বিতীয় বৃহত্তম পণ্য হলো সিরিয়াল বা খাদ্যশস্য। গত অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয়ের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে খাদ্যশস্য আমদানিতে। এর পরিমাণ ২২০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ১১৯ শতাংশ বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি বাবদ তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে মোটরযান ও যানবাহনের যন্ত্রাংশে, যার পরিমাণ ৭৭ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। মোট আমদানি ব্যয়ের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে এ পণ্যে। ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হয়েছে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
একসময় চিনি ব্রাজিল থেকে আমদানি হতো। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এ পণ্যেও ভারতনির্ভরতা বেড়েছে। গত অর্থবছরে ভারত থেকে চিনি আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। মোট আমদানি ব্যয়ের ৪ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে চিনিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে চিনি আমদানি বাবদ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬৭ শতাংশ।
গত অর্থবছরে ভারত থেকে খনিজ পণ্য ও জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫৪ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। মোট ব্যয়ের ৪ শতাংশ হয়েছে এ পণ্য আমদানিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ। যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ৫৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে ২৩ শতাংশ। ভারত থেকে মোট আমদানি ব্যয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশে।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ভারত থেকে বর্তমানে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। ঝাড়খন্ড থেকে আদানি পাওয়ারের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেশের গ্রিডে যুক্ত হলে দেশটি থেকে আমদানি বিদ্যুতের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট। আগামী বছর জুনের মধ্যে আদানি পাওয়ারের পুরো বিদ্যুৎ দেশের সক্ষমতায় যুক্ত হলে প্রায় ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ আমদানি হবে ভারত থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিডের অভিঘাত সামলে উঠতে না উঠতেই বৈশ্বিক বাণিজ্য খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে চলমান যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। কয়েকটি দেশ থেকে পণ্য আমদানি বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহাজ ও কনটেইনার সংকটের পাশাপাশি পরিবহন ভাড়াও বেড়েছে অনেক। এ আপত্কালে প্রতিবেশী ভারতের দিকেই বেশি ঝুঁকতে হচ্ছে বাংলাদেশী আমদানিকারকদের।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে দেশে আমদানীকৃত গমের ৭০-৮০ শতাংশ, চিনির ৯০ ও চালের ৭০-৮০ শতাংশ আসছে ভারত থেকে। আমদানীকৃত পেঁয়াজের শতভাগই আসছে ভারত থেকে। একসময় চাল ও গমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমদানির বাজার পুরোটাই ছিল ভারতনির্ভর। একক দেশের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে দেশে পণ্যগুলোর বাজার প্রায়ই অস্থিতিশীল হয়ে উঠত। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য এনেছিল বাংলাদেশ। চাল আমদানির উৎস দেশের তালিকায় ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের মতো দেশ। যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে পরিবহন ব্যয় কমাতে গিয়ে পণ্যটির আমদানিকারকরা এখন আবারো ভারতনির্ভর হয়ে পড়ছেন। বর্তমানে দেশে আমদানীকৃত চালের সিংহভাগই ভারত থেকে আসছে।
দেশে বার্ষিক গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। পণ্যটি আমদানিতে বাংলাদেশের নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি ছিল রাশিয়া, ইউক্রেন ও কানাডার ওপর। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশই আসত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের কারণে দুটি দেশ থেকেই আমদানি এক প্রকার বন্ধ। কানাডায়ও সর্বশেষ মৌসুমে খরার কারণে পণ্যটির উৎপাদন ভালো হয়নি। এ অবস্থায় গমের শীর্ষ সরবরাহকারী দেশ হয়ে উঠেছে ভারত। চিনি আমদানিতে অনেক আগে থেকেই ভারতনির্ভর বাংলাদেশ। বর্তমান পরিস্থিতি সে নির্ভরতা আরো বাড়িয়েছে।
ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অর্থনীতি এমন একটা জিনিস যে “পানি ঢালের” দিকেই যাবে। যেহেতু আমাদের কারখানার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামাল আনতে হয়, ট্রান্সপোর্টের ভাড়া পাঁচ-সাত গুণ বেড়ে গিয়েছে, সেজন্য পাশের দেশ থেকে আনাটাই ব্যবসায়ীদের জন্য সাশ্রয়ী হয়। যেহেতু ভারত থেকে আনা সহজ, তাই আমদানি বেড়ে গিয়েছে। এখন অন্য কোনো দেশ থেকে আনা যদি ভারত থেকেও সাশ্রয়ী হয়, তাহলে অবশ্যই সেদিকে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকবেন। যে দেশ থেকেই হোক, এখন কম দামে জিনিসপত্র এনে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। সেজন্য ভারত থেকে আনা যদি সস্তা হয়, অবশ্যই ভারত থেকে নিয়ে আসবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত থেকে প্রতিযোগিতা সক্ষম মূল্যে পণ্য পাওয়া গেলে সেটিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে বাজার বৈচিত্র্যকরণের গুরুত্ব রয়েছে। একক দেশের ওপর নির্ভরতার কিছু বিপদও রয়েছে। গম বা তুলার মতো অপরিহার্য পণ্য রফতানি আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে তা নতুন সংকটের জন্ম দেবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য বাড়াতে হবে। দেখা যাচ্ছে ভারতে রপ্তানিও বাড়ছে। বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নতুন অর্থনীতির আবির্ভাব হয়েছে। এ সুযোগ অবশ্যই আমাদের নিতে হবে। তবে বাজারে বিভিন্ন ধরনের বিষয়, যেমন রফতানি নিষেধাজ্ঞার মতো ইস্যু আছে, এ কারণে কোনো দেশের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে ছিন্ন করা ঠিক হবে না। যোগাযোগ অব্যাহত রেখে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অর্থনীতির সূত্র ধরেই বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’
এসডব্লিউএসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ