হাজার হাজার মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা জমে উঠছে। সহিংসতা ও দমন-পীড়নের ভয়ের পাশাপাশি ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর অর্থনীতিতে এসবের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতি-বিষয়ক পত্রিকা (জাপানের) নিক্কেই এশিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দ্বারা আয়োজিত ধারাবাহিক সমাবেশগুলোর সমাপ্তি হয়েছে শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশের মধ্য দিয়ে, যদিও সরকার এসব ঢাকা দিয়ে রাখতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
উল্লেখ্য, রাজধানীতে বিএনপির প্রধান কার্যালয় ঘেরাও করে রাখার পাশাপাশি দলটির নেতাকর্মীরা যাতে সমাবেশে যোগ দিতে না পারে সেজন্য রাস্তা অবরোধ করে রাখা হয়। এর তিন দিন আগে সমাবেশের জন্য দলটি প্রস্তুতি নেওয়ার সময় অন্তত একজন বিএনপি কর্মী নিহত হন এবং শত শত কর্মী গ্রেপ্তার হন। আটক হওয়াদের মধ্যে দলটির বেশ কয়েকজন নেতাও রয়েছেন।
বিএনপি ১০-দফা দাবির তালিকা পেশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার নির্দলীয় প্রশাসনের পথ তৈরির জন্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে দলটি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে, সরকার যে তার অবস্থান থেকে নড়বে, বিশেষজ্ঞ-পর্যবেক্ষকরা তা নিয়ে সন্দিহান। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে হতাশাগ্রস্ত।
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় লাভ করলেও (তাদের বিরুদ্ধে) সহিংসতার এবং ভোট কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। সরকার সেগুলো অস্বীকার করেছে। ডলার-সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতি-গ্রস্ত অর্থনীতির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বোঝা। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ (ভবিষ্যৎবাণী করা যায় না এমন) বিশেষভাবে বিপদজনক সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় ‘লেভেল ইলেক্টোরাল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তিনি নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, “বেসামরিক প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ এবং নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে এক হয়ে কাজ করেছে। নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই বিএনপির জন্য একমাত্র বিকল্প বলে তিনি মনে করেন। রীয়াজ বলছিলেন, বিএনপি আগামী দিনগুলোতে জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পারবে কিনা এবং অন্যান্য দল তার সাথে আন্দোলনে যোগ দেবে কিনা তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহ কয়েকটি সমমনা রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য কিছু ছোট দল বিএনপির দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। রীয়াজ বলেন, “নানা ধরনের সামাজিক স্তরের বহু মানুষ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ।” সরকার অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং বিরোধীদের (রাজনীতি করার) সুযোগ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মধ্যে রয়েছে বলেও তিনি জানান।
যথার্থই, সাম্প্রতিক সমাবেশগুলো নিয়ে হৈচৈ এবং সরকার কর্তৃক সেগুলো ব্যর্থ করার প্রচেষ্টার মধ্যে ঢাকাস্থ জাতিসংঘের প্রতিনিধি এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সহ বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি মিশনগুলো হাসিনা প্রশাসনকে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য অনুরোধ করেছে এবং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে।
রীয়াজের মতোই সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেনও সন্দিহান এই নিয়ে যে, কোনোভাবে বাধ্য করা না হলে সরকার বিরোধীদের দাবি পূরণ করবে। তিনি বলেন, “অতীতে আমরা সহিংসতা ছাড়া কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দেখিনি।” সরকার “জবরদস্তি”র সকল ক্ষমতা রাখে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, “আগামী ছয় মাস পর এবং আগামী বছরের শেষের দিকে সাধারণ নির্বাচনের আগে কী ঘটতে চলেছে তা নিয়ে আমি আশাবাদী নই। তবে আমি নিশ্চিত, কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলে, সরকার বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থার বাইরে কিছু করবে না, কারণ তাদের জন্য এটিই উপযুক্ত।”
(সরকারের উপর) চাপ আরও বাড়ানোর চেষ্টায় বিএনপির সংসদ সদস্যরা রবিবার পদত্যাগ করেছেন। তবে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ওইদিনই বলেছেন যে, তাদের পদত্যাগে কোনও প্রভাব পড়বে না, কারণ তারা সংসদের কয়েকটি মাত্র আসনের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। গত নির্বাচনে ৩০০ টির মধ্যে ২৪৭ টি আসনে জয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় মহাজোটের বিপরীতে বিএনপি মাত্র সাতটি আসন পেয়েছিল।
স্থানীয় গণমাধ্যম জানাচ্ছে কাদের বলেছেন, “সরকার পতনের দিবাস্বপ্ন দেখছে বিএনপি। শনিবারের সমাবেশে তারা আতঙ্ক সৃষ্টি ব্যতীত আর কিছুই করতে পারেনি। তাদের ১০ দফা দাবিতে নতুন কিছু নেই। তারা খেলায় হেরেছে, তারা নির্বাচনেও হেরে যাবে।”
ওদিকে, বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে এই অস্থিরতার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আশা ধূলিসাৎ হতে পারে। চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকেই যা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিল। ওই ঘটনা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ঢেউ তুলে। বড় সমাবেশগুলোর সময়ের রাজনৈতিক উত্তেজনা কিছু ব্যবসার উপর প্রভাব ফেলছে, কারণ যানবাহন সীমিত করা হয়েছে এবং সমাবেশের দুয়েক দিন আগে থেকেই দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
আরও বিস্তারিতভাবে বললে, দেখা যাচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে যা ৩৪ বিলিয়ন ডলারেরও নীচে নেমে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কঠোর গণনা পদ্ধতিতে তা হয় ২৬ বিলিয়ন ডলার। সরকার রিজার্ভ ঘাটতি পূরণে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য উদ্বিগ্নভাবে আইএমএফ বোর্ডের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করছে। যা দেশটিকে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের পর এ বছর আন্তর্জাতিক ঋণদাতার কাছে সাহায্য চাওয়া তৃতীয় সমস্যাগ্রস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশে পরিণত করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ের রিবাউন্ডিং এক্সপোর্ট এবং রেমিটেন্স দেশটি আরও গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে পারবে বলে আপাতত আশা জাগালেও, কর্মকর্তারা পরের বছরের শুরুর দিকে আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছেন। ওই সময় কিছু বড় বিদেশী ঋণের বকেয়া আসতে শুরু করবে।
(আন্তর্জাতিক) রেটিং সংস্থা মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস কর্তৃক গত শুক্রবার বাংলাদেশের ঋণমান পর্যালোচনায় রাখার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদনে। উল্লেখ্য, এর ফলে দীর্ঘকাল ধরে রাখা ঋণ মান ‘বিএ৩’-এর অবনতি হতে পারে। সেটা হলে দেশের বৈদেশিক লেনদেন ও ঋণ গ্রহণ আরো কঠিন হয়ে যাবে। এমন একটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে সংস্থাটি বলেছে, “বাংলাদেশের বাহ্যিক অবনতিশীল পরিস্থিতির কারণে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশটির বাহ্যিক দুর্বলতা ও সরকারের তারল্য ঝুঁকি এমনভাবে বেড়েছে যা বর্তমান রেটিংয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, সাধারণ নির্বাচনের আগে আগামী বছরটি “নিশ্চিতভাবে জটিল” হবে। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেগুলো পরস্পর জড়িত।” আইএমএফ’র প্রাক্তন শীর্ষ কর্মকর্তা মনসুর বলেন, ‘ক্যাপিটাল ফ্লাইট’ এবং বিনিয়োগ স্থগিত করার প্রবণতার মতো বিষয়গুলো সম্ভবত নির্বাচন-সম্পর্কিত অনিশ্চয়তার সাথে যুক্ত ছিল। এগুলোকে যথাযথ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে পরিচালনা করতে হবে। অন্যথায়, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টি বিপত্তির সম্মুখীন হতে পারে।”
এসডব্লিউএসএস/১৬১৮
আপনার মতামত জানানঃ