জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো এক বছরের বেশি সময় বাকি। এরই মধ্যে উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা। সহিংসতায় ঘটছে প্রাণহানিও। রাজপথে জানান দিতে নিয়মিত সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করে আসছে বড় দুই দল। দলগুলোর মাঠের কর্মসূচি ঘিরে বাড়ছে হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা। নেতাদের বক্তব্য নিয়ে চলছে কাদা ছুড়াছুড়ি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন কেউ কেউ। এদিকে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ সারা দেশে সরব হওয়ায় হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার হচ্ছেন বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। গত এক মাস ধরে বিএনপি সভা-সমাবেশ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে এসব ছাপিয়ে গেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা হামলা করছে বিএনপি নেতাকর্মীদের দোকানপাটে, ব্যবসা-বাণিজ্যে।
বরিশালে বিএনপি বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছিল ৫ নভেম্বর। কিন্তু গৌরনদী ও আগৈলঝড়ায় এর রেশ রয়ে গেছে এখনো। গত এক সপ্তাহে এই দুই উপজেলার ২৮টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দুটি নিবন্ধিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্ধ করেনি। বন্ধ করেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতারা। কেবল তা–ই নয়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হামলায় বিএনপির ১০ জন আহতও হয়েছিলেন।
গতকাল শুক্রবার এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হলে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ওই দিনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ১৬টি দোকান ও একটি এনজিও অফিস খুলে দেন। তারা দোকানের মালিকদের এই বলে অভয় দেন যে নির্বিঘ্নে তারা ব্যবসা করতে পারবেন। কোনো সমস্যা হবে না।
তবে এখনও পর্যন্ত বাকি দোকান ও একটি এনজিও তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। এই এনজিওর পরিচালক আনোয়ার খান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, এনজিওর পরিচালনা পর্ষদে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করলে সেটিও খুলে দেওয়া হবে। এটা কি মামাবাড়ির আবদার? এই এনজিওর সঙ্গে এলাকার অনেক গরিব মানুষের ভাগ্য জড়িত।
এটি বন্ধ থাকলে এর কর্মকর্তা–কর্মচারীরাই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এর উপকারভোগীরাও। বিএনপির নেতার এনজিও আওয়ামী লীগারদের জবরদস্তিভাবে ভাগ বসানোর কি যুক্তি থাকতে পারে, তা–ও একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে?
উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের মালিক ও এনজিও কর্মকর্তারা বিএনপি করতে পারেন। আবার কেউ বিএনপি না করেও তাদের সমাবেশে যেতে পারেন। সে জন্য তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো তালাবদ্ধ করে দেওয়া হবে? দেশে কি আইনকানুন বলে কিছু নেই?
ক্ষমতাসীন দলের বাঘা বাঘা নেতারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ বলেন। একই সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কত বছর আগে কোথায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তারও বিশদ বিবরণ দেন। বিএনপির নেতাদের দোকান ও এনজিও তালাবদ্ধ করে তাঁরা কী ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চান?
উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা যা খুশি তাই করতে পারেন? বিএনপি নিষিদ্ধ কোনো দল নয়। তাদের সমাবেশে কেন উল্লিখিত দোকানের মালিক ও এনজিও কর্মকর্তারা যেতে পারবেন না?
আওয়ামী লীগ রাজপথ থেকে উঠে আসা একটি দল। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামেও তারা নেতৃত্ব দিয়েছে। ভাবা যায়, এই দলের নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও এনজিও বন্ধ করে খোলার শর্ত হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পূর্বশর্ত জুড়ে দিয়েছেন! আইনের শাসনের প্রতি ন্যূনতম আস্থা থাকলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এটা করতে পারতেন না।
এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা কেবল অগ্রহণযোগ্য নয়; দায়িত্বহীনও। কারও দোকান, অফিস দখল হয়ে যাওয়ার পরও লিখিত অভিযোগ দেওয়ার দরকার হবে কেন? জবরদখল থেকে প্রতিষ্ঠান উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ।
এদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে দেশব্যাপী বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নানা কায়দায় জুলুম-নির্যাতনের খেলা যেন থামছেই না।
তিনি বলেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে এবং দেশব্যাপী ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই এখন আওয়ামী সরকারের মূল নীতিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী সরকারের কোনো গণভিত্তি নেই বলেই তারা মানুষের সমাগম দেখলেই আঁতকে উঠে। আর সেজন্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিএনপি’র সভা-সমাবেশে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে, যখন গণসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি, সরকার অনুমতিও দেয়। স্বাভাবিকভাবে মানুষ আশা করেছিল, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশটি হয়ে যাবে। সমাবেশের আগে ও পরে সেখানকার জনজীবন স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু বিএনপি সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডেকে বসলেন। সংশ্লিষ্টরা বললেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও মহাসড়কে নছিমন, করিমন, মাহিন্দ্রা, অতুল, ইজিবাইকসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচলের প্রতিবাদে দুদিন পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাসমালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডাকলে সরকারের বা আওয়ামী লীগের কী করার আছে। সত্যিই কি তাদের কিছু করণীয় নেই? মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
উল্টো এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেছেন, বিএনপির গণসমাবেশের আগে যে ধর্মঘট করা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং সাধারণ শ্রমিক-মালিকদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। পুরোপুরি সরকারের নির্দেশে অতি উৎসাহী পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসন আর ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে পরিবহন ধর্মঘট করেছে।
যেকোনো কমর্সূচিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গণপরিবহন বন্ধ থাকলে কমর্সূচি আহ্বানকারী রাজনৈতিক দল যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয় বেশি। এতে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন কিছুটা হলেও কমে।
সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ধরে রাখতে ও জনদুর্ভোগ এড়াতে সমাবেশের আগে গণপরিবহন চালু রাখা যেতে পারে। আগামীকাল শনিবার ফরিদপুরে বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে একটি গোয়ন্দা সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থাটির মতে, গণসমাবেশের সময় পরিবহন বন্ধের কারণে জনদুর্ভোগের বিষয়টি গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়েছে, যাতে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ উপলক্ষে কয়েকটি স্থানে শুরু থেকেই বিএনপির নেতা–কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পযর্বেক্ষণে বলা হয়েছে, বিএনপি গণসমাবেশ করে জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে পুনরায় শক্তি ফিরে পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সম্প্রতি গণসমাবেশে আশানুরূপ জনসমাগম হওয়ায় বিএনপি মনে করছে, তাদের জনসমর্থন আগের চেয়ে বাড়ছে এবং সাধারণ জনগণ তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে।
এসডব্লিউএসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ