একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক একেবারে শেষের মুখে। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান মানুষকে কিই না দিয়েছে। মহাকাশে চন্দ্রযান দুই পাঠাচ্ছে ভারত, দেশের প্রতিভাধর নাগরিকরা বিদেশের মাটিতে গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। আর এই ভারতে এখনও চলছে নরবলি।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় দুই নারীকে নরবলি দিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। সন্দেহমূলকভাবে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) এক মাসের ব্যবধানে খুন হওয়া ওই দুই নারীর দেহাবশেষেরও সন্ধান মেলে।
পুলিশ জানায়, অভিযুক্তদের মধ্যে এক দম্পতিসহ আরেক ব্যক্তিও রয়েছে, নরবলি দেওয়ার আগে তারা ভিকটিমদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা অভিযোগ স্বীকার করেছে এবং এনিয়ে আরও তদন্ত চলছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়ালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেরলের এর্নাকুলামের বাসিন্দা, দুই নারী রোজেলিন ও পদ্মাকে বেশ কয়েকমাস ধরেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তারা রাস্তার ধারে স্টল দিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি করতেন। গত জুন মাসে আচমকাই নিখোঁজ হয়ে যান রোজেলিন। সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন পদ্মাও। তল্লাশি করতে গিয়ে শেষমেশ বেরিয়ে আসে এক ভয়ংকর তথ্য। জানা যায়, দুই নারীই নরবলির শিকার হয়েছেন।
সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে, রাতারাতি বড়লোক হতেই নাকি এই দু’জনকে বলি দিয়েছে এক দম্পতি। তার পরে মাংস খেয়েছেন সেই দেহের।
প্রথমে দুই নারীর গলা কেটে খুন করা হয়। তার পর তাদের দেহ একেবারে টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তাবন্দি করে দু’টি আলাদা আলাদা জায়গায় পুঁতে দেওয়া হয়।
আজ বুধবার গ্রেপ্তারকৃতদের কোচি সিটির একটি আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালত তাদের তিন সপ্তাহ পুলিশি হেফাজতের আবেদন মঞ্জুর করেন।
কোচি পুলিশ কমিশনার সিএইচ নাগারাজু বলেছেন, হত্যাকাণ্ড দুটি গত চার মাসের বেশি সময় ধরে সংগঠিত হয়েছে। ‘আর্থিক স্বচ্ছলতার’ আশায় কোনো তন্ত্রসাধনার অংশ হিসেবেই আসামীরা ভিকটিমদের নরবলি দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের পেছনে আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমরা প্রাথমিকভাবে এ অনুমান করছি। এছাড়া আসামীদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেও তদন্ত করা হচ্ছে। ‘ফরেনসিক পরীক্ষা চলছে, সবরকম প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত আমাদের ধারণা অভিযুক্তরা সাইকোপ্যাথ এবং পার্ভার্ট’।
সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে, রাতারাতি বড়লোক হতেই নাকি এই দু’জনকে বলি দিয়েছে এক দম্পতি। তার পরে মাংস খেয়েছেন সেই দেহের।
ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলে আজো চর্চা করা হয় ‘কালো জাদুর’। জনমনে বিশ্বাস আছে, এর চর্চা আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে ও গর্ভধারণে সহায়তা করে, দুরারোগ্য যেকোনো রোগ সারাতে পারে; এমনকী ঘটাতে পারে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত।
পুলিশ আরও জানায়, পথনামত্থিতা জেলায় সিং দম্পতির বাড়ির কাছে পুঁতে রাখা ভিকটিমদের খন্ডবিখণ্ড দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে।
বিকৃত দেহগুলি দেখে নিহতদের শনাক্ত করতে পারেনি তাদের পরিবার। তাই পরিচয় নিশ্চিত হতে তাদের ডিএনএ নমুনা ল্যাবটরিতে পাঠানো হয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নরবলি বা শিশুবলির মতো কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথা এখনও চলেছে, হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজেই৷
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র, জলপড়া বা তান্ত্রিকদের দাপট চলছে দিব্যি৷ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই কুসংস্কারের বলি হচ্ছে অনেক জীবন৷ সহজ নিশানা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাবালক-নাবালিকারা৷
ভারতে কুসংস্কার এশিয়ার যেকোনো দেশের তুলনায় আছে প্রবলভাবে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে ১০৭ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কুসংস্কার রোধে সঠিক সরকারি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবকেই দায়ী করছে কংগ্রেস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সবের বড় কারণ অশিক্ষা আর দারিদ্র৷ অন্ধবিশ্বাসে চালিত হয়ে এরা ভাগ্যের ওপর সব কিছু ছেড়ে দেয়৷ আর সেই সুযোগটাই নেয় তান্ত্রিকরা৷ নানা রকমের ঝাড়ফুঁক, কবজ-তাবিজ, পশুবলি, এমনকি নরবলি কিংবা শিশুবলি দিয়ে ভাগ্য ফেরাবার অথবা গুপ্তধন পাবার পরামর্শ দিয়ে থাকে তারা৷ এটা এখনও চলছে৷ পুলিশ প্রশাসন এটা বন্ধ করতে তেমন গা করছে না৷
এই নরবলি প্রথা শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ছিল; তবে অতীতে৷ প্রাচীন গ্রিসে দেবতা জিউসের সামনে শিশুবলি দেবার প্রমাণ পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা৷ খরস্রোতা নদীর ওপর বাঁধ ও সেতু নির্মাণের আগে কিংবা ঘরবাড়ি তৈরির আগে অশুভশক্তিকে তুষ্ট করতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল জাপানে৷
মিশরে ফারাওদের কবরের সঙ্গে বেশ কিছু ক্রীতদাসকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হতো৷ দক্ষিণ এশিয়াতেও বড় বড় রাজা-মহারাজা বা জমিদারেরা বিশেষ কামনা পূরণের জন্য নরবলি দিত৷ নরমুণ্ড মালিনী, জিবে রক্তধারা, হাতে খাঁড়া নিয়ে দেবি কালীর বা দেবি চামুন্ডার বিগ্রহে অথবা বেদীতে নরবলি ছিল মর্যাদার প্রতীক৷ কালক্রমে এ প্রথাই মোষবলিতে বা পাঁঠা বলিতে নেমে আসে৷ হিন্দু পুরাণেও অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো নরমেধ যজ্ঞের উল্লেখ আছে৷ কিন্তু এই একবিংশ শতকে এসে মধ্যযুগের এই বর্বরতার চর্চা মেনে নেয়া যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৯
আপনার মতামত জানানঃ