নুপূর শর্মা, নবীন জিন্দলের পর বিজেপি নেতাদের ইসলামোফোবিয়ার আরেকটি উদাহরণ সামনে এলো। এবার দিল্লির বিজেপি সাংসদ প্রবেশ বর্মা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে মারাত্মক কথা বলেছেন।
মুসলিমদের নাম না করে তিনি বলেছেন, “ওদের বয়কট করুন। ওদের স্টল থেকে সবজি কেনার কোনো দরকার নেই। ওরা যদি লাইসেন্স ছাড়া মাংসের দোকান খোলে, তা হলে পৌরসভাকে বলে বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন।”
প্রবেশ বর্মা বলেছেন ”আপনারা যদি ওদের সোজা রাখতে চান, তাহলে সম্পূর্ণ বয়কট করুন। আপনারা কি এটা মানেন? মানলে হাত উঁচু করুন এবং আমার সঙ্গে বলুন, আমরা ওদের বয়কট করব এবং ওদের চাকরিতে রাখব না। ”
প্রবেশ বর্মার এই মন্তব্য সহ ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এই কথা যে তিনি বলেছেন, তা প্রবেশ বর্মা মেনে নিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি জানিয়েছেন, ”আমি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাম করিনি। ওখানে একজন যুবককে খুন করার প্রতিবাদে সভা ডাকা হয়েছিল। যারা খুন করেছে, আমি তাদের পরিবারকে বয়কট করার কথা বলেছি।”
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ(ভিএইচপি)-র দাবি, সুন্দর নগরীতে মনীশ কুমার নামে এক ব্যক্তিকে তিনজন মিলে খুন করেছে। তারা সকলেই মুসলিম। তারই প্রতিবাদে জনসভা ডেকেছিল তারা।
কিন্তু বিরোধী কংগ্রেস, এআইএমআইএম নেতারা নিশ্চিত, প্রবেশ মুসলিমদেরই বয়কট করতে বলেছেন।
একই অনুষ্ঠানে ছিলেন দিল্লির বিজেপি বিধায়ক ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা বিনোদ বনসল। তিনি বলেছেন, মনীশ কুমারকে ”জেহাদি মনোভাবের মানুষেরা খুন করেছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম। আমরা যদি চাই তো, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওদের শিক্ষা দিতে পারি। কিন্তু আমরা আইন মেনে চলি। দেশের বিচারবিভাগের উপর আমাদের আস্থা আছে।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেস মুখপাত্র শামা মোহামেদের প্রতিক্রিয়া, ”বিজেপি সাংসদ প্রবেশ বর্মা দিল্লির মানুষকে বলেছেন, তারা যেন আর্থিক দিক থেকে মুসলিমদের বয়কট করে। এরপরেও কি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশ প্রবেশ বর্মার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না? প্রধানমন্ত্রী কি এর নিন্দা করবেন না? নাকি এটাই বিজেপি-র সবকা সাথ সবকা বিকাশ?” তিনি তার টুইটে প্রধানমন্ত্রীকেও ট্যাগ করেছেন।
সংবাদসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, দিল্লি পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার তাদের বলেছেন, কেউ পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। তবে ভিডিও ফুটেজ পুলিসের কাছে আছে। তারা তা খতিয়ে দেখছে।
এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, ”বিজেপি সাংসদ দেশের রাজধানীতে জনসভায় খোলাখুলি মুসলিমদের বয়কট করানোর শপথ দেওয়াচ্ছেন। বিজেপি কি দিল্লিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলো? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল কেন চুপ করে আছেন?”
ওয়েইসির দাবি, ”সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে অস্পৃশ্যতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনোভাবে অস্পৃশ্যতা ছড়ালে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। দেশের ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ যদি এই কথা বলেন তো সংবিধানের আর কি মূল্য রইল?”
এতো বিদ্বেষ কেন?
আসামের দারাং জেলায় বিজেপি রাজ্য সরকার মুসলমানদের ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদকালীন সেই ভিডিও ফুটেজের কথা কি মনে আছে? যেখানে দেখা গিয়েছিল, এক গ্রামবাসীকে মেরে ফেলার পর একজন ফটোসাংবাদিক তার প্রাণহীন দেহের ওপর লাফিয়ে পড়ে লাথি মারছেন।
দু বছর আগে ফিরে গেলে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় দাঙ্গা হয়েছিল। এতে কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই মুসলমান নাগরিক।
ভারতে মুসলমান নাগরিকদের গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনাও নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গরুর মাংস খাওয়ার ‘অপরাধে’ প্রায়ই মুসলমানদের ওপর চড়াও হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস খাওয়াকে নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়েছে এবং পুলিশ ও স্বপ্রণোদিত উন্মত্ত জনতা বিচারবুদ্ধি ছাড়াই সেই আইন ‘প্রয়োগ’ করার বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই ‘গো-রক্ষকেরা’ মুসলমানদের পেটানো এবং মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে বাধ্য করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এ ধরনের ঘৃণা ছড়ানো অপরাধ সংঘটিত হলেও কেউ কোনো সাজা পাচ্ছে না।
প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ”দিল্লি পুরসভার নির্বাচন আসছে। বিজেপি সেখানে ক্ষমতায় আছে। কেজরিওয়ালের আপ এবার পুরসভা দখল করতে চায়। প্রতিটি নির্বাচনের আগে এরকমভাবেই বিভাজনের চেষ্টা চলে। এভাবেই তারা জিততে চায়। পুরসভা নির্বাচনেও আগেও এইভাবে বিভাজনের চেষ্টা হচ্ছে।”
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘ দেশ কা গদ্দারো কো’, আর সামনে বসা বিজেপি-র কর্মী-সমর্থকরা ধুয়ো তুলেছিলেন, ‘গোলি মারো … কো’।
মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক আশিস গুপ্তর দাবি, ”গত কয়েক বছরে দিল্লিতে বিজেপি নেতারা একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।” ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ”একজন নেতার বিরুদ্ধেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি।”
আশিস বলেছেন, ”সাংসদ হিসাবে তো প্রবেশ বর্মা সংবিধান অনুয়ায়ী শপথ নিয়েছেন। অথখচ তিনি যা বলেছেন, তা সংবিধানবিরোধী কথা। তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। নূপুর শর্মার ক্ষেত্রে বিজেপি বলেছিল, তারা একেবারে গুরুত্বহীন নেতা। প্রবেশ বর্মার মতো সাংসদের বিরুদ্ধে তো তা বলা যাবে না।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ