বায়ুদূষণ ছোট বড় সবার জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। তবে কখনো কি ভেবে দেখেছেন, গর্ভের সন্তানটি এই বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীর আলো না দেখলেও গর্ভে থাকা ছোট্ট শিশুটিও কিন্তু বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে, এমনই তথ্য জানিয়েছে গবেষকেরা।
বায়ুদূষণ যত বাড়ছে, ততই কমছে গর্ভস্থ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ। গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে ফুসফুস এবং যকৃতের। শহরাঞ্চলের দূষিত আবহাওয়ায় মাতৃজঠরে বেড়ে ওঠা শৈশবের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে এ বার এমনই শঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে একটি গবেষণাপত্রে।
বেলজিয়ামের হ্যাসেল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিম নওরোট এবং তার সহকারীদের ওই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটেনের সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ানে’। তাতে বলা হয়েছে, দূষণকবলিত অঞ্চলগুলিতে ভ্রূণের মস্তিষ্ক, ফুসফুস এবং যকৃতে দূষিত কণার উপস্থিতি মিলেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাথন গ্রিগ এবং তার সহকর্মীরা প্রথম শহরাঞ্চলে মানবভ্রূণে বায়ুবাহিত দূষিত কণার উপস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন।
হ্যাসেল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল স্কটল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের তুলনামূলক কম দূষণপ্রবণ শহরাঞ্চলের অধূমপায়ী প্রসূতিদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে ভ্রূণে উদ্বেগজনক হারে কার্বন-সহ নানা দূষণকণার উপস্থিতি পেয়েছে। দূষণপ্রবণ অঞ্চলে এই পরীক্ষার ফল আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
উন্নয়নের ‘সৌজন্যে’ শহর থেকে উধাও হচ্ছে সবুজ। বাড়ছে কলকারখানা আর গাড়ির সংখ্যা। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণ। এই আবহে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু-কিশোরের সংখ্যা বৃদ্ধিও উদ্বেগজনক।
শহরাঞ্চলে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) আক্রান্তের মধ্যে শিশুদের হারের উদ্বেগজনক বৃদ্ধির কথা কিছু দিন আগেই একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছিল। এ বার জানা গেল, দূষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না গর্ভস্থ শিশুরাও।
এ সম্পর্কিত আরও একটি গবেষণা হয়েছিল গতবছর। ওই গবেষণায়, প্লাসেন্টা বা গর্ভফুলে অতিক্ষুদ্র কার্বন কণার অস্তিত্ব পান গবেষকেরা। গবেষণাপত্রটি বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনস–এ প্রকাশিত হয়েছে।
ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভ্রূণের বেড়ে ওঠায় গর্ভফুলের যে অংশ থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান সরবরাহ করা হয়, সেখানে অতিক্ষুদ্র কার্বন কণার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
প্লাসেন্টা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা গর্ভের সন্তানকে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান সরবরাহ এবং শিশুর রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। অ্যালকোহল, নিকোটিন ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য গর্ভফুল পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম, যে কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে এসব থেকে দূরে থাকতে বলা হতো।
এখন দেখা যাচ্ছে, এই অতিক্ষুদ্র কার্বন কণাও গর্ভফুলে যেতে সক্ষম। এই অতিক্ষুদ্র কার্বন কণা অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ফুসফুস থেকে গর্ভস্থ ভ্রূণে গিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
চিকিৎসকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বায়ুর শহর এখন ঢাকা। এর প্রভাবে অনেক মায়ের গর্ভের সন্তান নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে আসছে। একই সঙ্গে দূষণ প্রভাব ফেলছে শিশুদের সুষ্ঠু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠনেও।
তাছাড়া বায়ু দূষণের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৃথিবীতে আসছে শিশুরা (প্রি-ম্যাচিউর বার্থ), অনেক শিশুর ওজন আবার বেশ কম হচ্ছে। যা জন্ম-পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতা তৈরি করে।
আমরা এতদিন বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলতাম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া অদ্ভুত আচরণ করছে। এখন আর এটি ষড়ঋতুর দেশ নেই। অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষায় খরা হচ্ছে। এ ধরনের পরিবর্তন আমাদের সামাজিক অবস্থা ও খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে শিশুদের ওপর।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় রোগজীবাণুর বিস্তার বেশি হয়। এটা শিশুদের সবচেয়ে বেশি এফেক্ট করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান যাচাই বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউ এয়ার’-এর তথ্য মতে, ২২ আগস্ট দুপুর ১-২টা পর্যন্ত ঢাকায় বায়ুর মান সূচক ছিল ৯৭। ওই সময় বায়ুতে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ‘পিএম ২.৫’ প্রতি ঘন মিটারে ছিল ৩৯.৪ মাইক্রোগ্রাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বায়ু ‘স্পর্শকাতর গ্রুপের মানুষের (অনাগত সন্তান ও শিশু) জন্য অস্বাস্থ্যকর’।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক শারাবান তাহুরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণের ফলে নারীদের গর্ভে থাকা শিশুরা ‘লেড পয়জনিং’-এর শিকার হচ্ছে। এর ফলে গর্ভের শিশু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
মা যখন দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকেন, বায়ুর মধ্যে যদি ডাস্ট বা কেমিক্যাল থাকে সেক্ষেত্রে শিশুর ওপর টেরাটোজেনিক ইফেক্ট পড়ে। মাতৃগর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে, তার হার্ট বা লাঙ্গসে অসঙ্গতি হতে পারে। অনেকসময় হার্টে ছিদ্রও হতে পারে দূষণের কারণে।
তিনি বলেন, ‘একজন মা গর্ভবতী হওয়ার প্রথম ৩ মাসে শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি হয়। এই সময়টায় যদি কোনো নারী বায়ু দূষণের শিকার হয় তাহলে তার গর্ভের সন্তানের বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতও হতে পারে। এই সময়টা খুবই সেনসিটিভ।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অনাগত নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব সব বয়সী শিশুদের জন্য অভিশাপ হিসেবে এসেছে। বর্তমানে শিশুরাই এর সর্বোচ্চ মূল্য দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের তারতম্য ব্যাপকভাবে হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের।
গত ৫০ বছরে দেশে দিন ও রাতে উষ্ণতার হার বেড়েছে, অসময়ে বন্যা হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে নদী ভাঙন। এসবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মাশুল দিচ্ছে শিশুরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৮
আপনার মতামত জানানঃ