সারা দেশে এবার বিএনপি, জামায়াত ও বিরোধীদলের কর্মসূচি সফল করতে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অর্থযোগানদাতা, জনবল সংগঠক ও সহযোগীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ।
সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপাররা তাদের অধীনস্থ সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে বিএনপি-জামায়াত ও অনান্য সরকার বিরোধী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক, অর্থ যোগানদাতাদের তালিকা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন।
পাশাপাশি বিএনপি নেতাদের নাম-ঠিকানার পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও সংগ্রহ করা হচ্ছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এসবি) রাজনৈতিক শাখা থেকে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার ও মহানগরের পুলিশ কমিশনারের কাছে বিএনপিসহ অনান্য বিরোধীদলের কর্মসূচি সফল করতে যারা কাজ করছে তাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এরকম নির্দেশনার আলোকে অনেক জেলার পুলিশ সুপাররা জেলার সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে বিএনপি-জামায়াত ও অনান্য সরকার বিরোধী সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক, অর্থ যোগানদাতাদের তালিকা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন।
সূত্র মতে, সারা দেশের অন্তত সাতজন পুলিশ কর্মকর্তা (পুলিশ সুপার ও মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার) বিরোধীদলের অর্থ যোগানদাতাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহের বিষয়টির সত্যতা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখিত চিঠিতে প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে আটজনের নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ও জাতীয়পরিচয়পত্র নম্বর সংগ্রহ করে ওই জেলার বিশেষ শাখায় (ডিস্ট্রিক্ট স্পেশাল ব্রাঞ্চ-ডিএসবি) শাখায় পাঠানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
একই সাথে উপজেলা পর্যায়ে কমপক্ষে পাঁচজন পৃষ্ঠপোষক, পৌরসভা পর্যায়ে ৫ জন ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমপক্ষে পাঁচজন করে বিএনপি-জামায়াত ও সরকার বিরোধীদের অর্থযোগান দাতাদের তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
বরিশাল রেঞ্জের একজন জেলা এসপি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমি চিঠি পেয়েছি এবং যারা দলীয় কর্মসূচিতে পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাদের খতিয়ে দেখছি।”
“আমরা তাদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করার পরে একটি প্রতিবেদন জমা দেব তবে এটি একটি নিয়মিত তদন্ত। এই বিষয়ে ব্যক্তিদের হয়রানি, জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেপ্তার করা হবে না।”
তবে বিশেষ শাখার উপ-মহাপরিদর্শক (রাজনৈতিক) এজেডএম নাফিউল ইসলাম বলেন, “কোনো নেতা-কর্মী মারা গেছে কিনা বা তাদের অবস্থান ছেড়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য আমরা প্রতি দুই-তিন মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা আপডেট করি। এছাড়া দলগুলোর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্যও আমাদের হালনাগাদ করতে হবে।”
“এটা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। আমরা এটা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বা অন্য সব দলের ক্ষেত্রেই করে থাকি।”
পুলিশের বিশেষ শাখা এসবি’র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ব্যক্তিদের তালিকা করা হয়।
“নির্বাচনের আগে যাতে, জ্বালাও-পোড়াও ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য আগে থেকে এসব ব্যক্তিদের নজরদারিতে রাখা হয়। এমনকি তাদের মধ্যকার আর্থিক লেনদেনও নজরদারিতে রাখা হয়। সর্বোপরি, দেশের স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এমন তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার পুলিশ সুপার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও তিনি বিএনপি জামায়াতের অর্থ যোগানদাতাদের তালিকা তৈরির বিষয়ে সরাসারি কোন মন্তব্য করতে চাননি। আরো অনেক পুলিশ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হন নি।
এদিকে, খুলনা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান বলেন, “এ ব্যাপারে আমাদের কোন মন্তব্য নেই। এমন নির্দেশনা যদি এসেও থাকে এটা একেবারেই আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের ইন্টার্নাল কাজের ব্যাপারে সাংবাদিকরা জানতে চাইতে পারেন না।”
এদিকে, ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রামে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতাদের তালিকা করছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ১৬ থানায় এই তালিকা করা হচ্ছে বলে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তালিকায় বিএনপি নেতাদের নাম-ঠিকানার পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সম্প্রতি, জুলাই মাসের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ডিএমপির ৫০টি থানা এলাকায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের হালনাগাদ তালিকা করার নির্দেশ দেন।
একই সাথে, কমিটির তালিকার বাইরে কোন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কতটি মামলা, কি কি মামলা ও তাদের বর্তমান অবস্থান সর্ম্পকে জানাতে বলা হয় নির্দেশনায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “পুলিশ অনেক আগে থেকেই বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে দমন-পীড়ন করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দমন-পীড়ন ও চাপ বাড়াতেই এমন তালিকা করছে পুলিশ। নেতাকর্মীদের তো গ্রেপ্তার, নির্যাতন করছেই, এবার শুভাকাঙ্খী ও পৃষ্ঠপোষকদেরও ছাড় দিবে না তারা।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই আবর্তিত হবে আগামী কয়েক মাসের রাজনীতি। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পালা দিয়ে জোরদার হবে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে সরকার মূলত প্রশাসনকে দিয়ে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখতে চাইছে। কৌশলে নির্যাতনের খড়গ নামিয়ে আনতে চাইছে।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ১৫/১৬ মাস বাকি। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক আন্দোলন দেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর তাই সরকার দমন পীড়নের নীতি গ্রহণ করছে। ইতিমধ্যেই রাজপথে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ একই সাথে হামলা চালাচ্ছে। কারণে-বিনাকারণে গ্রেপ্তার করছে। মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১৮-এর নির্বাচনকালীন সময়ে এমনই এক তালিকা করা হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিএনপি নেতাদের। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলেই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ