ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় স্নাতক চতুর্থ বর্ষের কিছু ছাত্রীকে আবাসিক হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রীভা। ওই হুমকির একটি অডিও রেকর্ড গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার মুখে ক্ষমাও চেয়েছিলেন তিনি।
ক্ষমা চাওয়ার পরও বিতর্ক পিছু ছাড়ল না ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রীভার।
সেই অডিও ফাঁসের ঘটনায় ফের নতুন বিতর্কে জড়ালেন এ নেত্রী। এবার দুই ছাত্রীকে ৭ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন এবং নগ্ন করে ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল করার হুমকির অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের এই নেত্রীর বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীরা এ গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে রীভা দাবি করেছেন, তিনি উল্লিখিত সময়ে হলে ছিলেন না।
ভুক্তভোগী ছাত্রীদের অভিযোগ, সেই অডিও ফাঁস হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে রিভা মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে রাজিয়া হলের ২০২ নাম্বার কক্ষ থেকে বঙ্গমাতা হলের ১১০৭ নাম্বার রুমে নিয়ে যান দুই ছাত্রীকে। বিকেল ৫.৩০টা পর্যন্ত সেখানে দুজনকে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য ও রাজিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা গিয়ে দুজনকে করে হল অফিসে নিয়ে আসেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সেই অডিও কে রেকর্ড করল আর ফাঁস করল – তা জানতে তাদের সকাল ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত রিভার কক্ষে আটকে রাখা হয়।
দুই ছাত্রীকে রিভার কক্ষে আটকে রাখার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে রাজিয়া বেগম হলের প্রাধ্যক্ষ নার্গিস রুমা গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা এসেছি। ঘটনার তদন্ত করব।
এদিকে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী তামান্না জেসমিন রীভা বলেন, একটা মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সংবাদ করাতে চাইছে। আমি কাকে নাকি নির্যাতন করেছি এমন বর্ণনা নিয়ে তারা এটা করাতে চাইছে। আমি সকাল থেকে ক্যাম্পাসের নিচে আমাদের প্রোগ্রাম নিয়ে সবাইর সঙ্গে ছিলাম। সন্ধ্যার পরে পার্টি অফিসে গেছি। তারা যে সময়ের কথা বলছে আমি সে সময়ে ছিলামই না।
আমি যদি একটা সিট না দেই, ২০২ থেকে তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’
গতকাল বিকেলে ফাঁস হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রী এবং শিক্ষক ভুক্তভোগী ২ শিক্ষার্থীকে ঘটনা খুলে বলার জন্য নানাভাবে আশ্বস্ত করছেন।
ভিডিওতে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, ছাত্রলীগ সভাপতি তাদের আটকে রেখে ‘এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পায়ে টাইনা ছিঁড়ে ফেলব’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ মিথ্যা এই মর্মে স্বীকারোক্তি দিতে বলেন। ওই ঘটনার অডিও রেকর্ড করতে নির্দেশ দিয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুমনা মীম—এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেন। স্বীকারোক্তি না দিলে বিবস্ত্র করে ভিডিও করে ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেন রীভা। তখন ওই ২ শিক্ষার্থী রিভার লিখে দেওয়া স্বীকারোক্তি পড়তে বাধ্য হন। সেটি রিভা এবং অন্যরা রেকর্ড করেন।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী জানান, রাজনৈতিক নানা কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করেন রীভা। অসুস্থ থাকলেও ছাড় দেন না তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই এই নিপীড়ন চলছিল। কিন্তু সেদিন প্রমাণ রাখার জন্য তিনি অডিও রেকর্ড করেন। ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুমনা মীম তাকে কখনো এ ব্যাপারে নির্দেশনা বা পরামর্শ দেননি।
এর আগে তামান্না জেসমিন রিভার একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। যেখানে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ার কারণে কক্ষে রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের ২০২ নম্বর রুমের কয়েকজন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিতে শোনা যায় তামান্নাকে।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সেই অডিওতে তামান্নাকে বলতে শোনা যায়, ‘বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করতেছিস। এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ধইরা ছিঁড়া ফেলমু। চার মাস হয়ে গেছে ফাইজলামি শুরু করছিস৷ তোরা লিগ্যাল তাতে আমার…। কোন হ্যাডাম দেখাইতেছিস তোরা? আমার পলিটিক্যাল রুমে তোরা লিগ্যাল থাকবি কি না, সেটা তোদের বিষয়। কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস? বুঝিস না, পলিটিক্যাল রুমে থাকিস! তোদের লিগ্যাল করাইছে, তাতে আমার…? আমি যদি একটা সিট না দেই, ২০২ থেকে তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’
একপর্যায়ে এক ছাত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘ও তো অসুস্থ, বাসায় গেছে।’
উত্তরে তামান্না বলেন, ‘২০২-এ আর লিগ্যাল কে? তোরা লিগ্যাল, তাতে আমার কি…?আমি কি…তোদের? ম্যাডামদের ক্ষমতা আছে, আমাদের রুম থেকে একটা মেয়েকে বের করার? ইডেন কলেজের প্রিন্সিপালেরও ক্ষমতা নেই এই রুম থেকে একটা মেয়েকে বের করার। রুমটা যেহেতু ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্ট নিয়ে নিছে, ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্টের ওপরে আর কেউ নাই। একদম গলায় পাড়া দিয়ে ধরতে ইচ্ছা করতেছে।’
ভাইরাল হওয়ার পরই শুক্রবার রাতে তামান্না নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টি স্বীকার করে ক্ষমা চান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই বললেই চলে। এরপরও ছাত্রলীগ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারবে না বলে হুমকি দেওয়া তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পেয়েছে।
তারা বলেন, ছাত্রলীগ নামধারী যারা সহপাঠীকে মারধর করেছেন এবং হত্যার হুমকি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। আমরা জানি, অপরাধের বিচার হলে ও অপরাধীরা শাস্তি পেলে তাদের শঙ্কিত হওয়ার কথা। কিন্তু ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীরা এতটাই বেপরোয়া যে শাস্তিও তাদের দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারছে না। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কীভাবে এর দায় এড়াবে?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৩
আপনার মতামত জানানঃ