ডলারসংকটের এই সময়ে চীন ও ভারতের সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের সুপারিশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে।
এমসিসিআই সভাপতি মো. সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে দেখা করে এ প্রস্তাব দেয়। গভর্নর তাদের বলেছেন, বিশেষ করে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারকরা যেন চীনা মুদ্রা রেনমিনবি (আরএমবি) ব্যবহার করতে পারেন, এ জন্য পরিপত্র জারি করা হবে।
ব্যবসায়ীরা জানান, সর্বশেষ খোলাবাজারে প্রতি ডলার রেকর্ড ১১২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ডলারসংকটের ফলে ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনীয় ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ডলারের বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ভারতের সঙ্গে রুপিতে এবং চীনের সঙ্গে আরএমবিতে আমদানি-রপ্তানি বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া গেলে মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। চীন ও ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, তাই এর মাধ্যমে দেশে ডলারের রিজার্ভসংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করেছে ৫২ বিলিয়ন ডলারের। একই অর্থবছরের জুলাই থেকে গত মে পর্যন্ত বাংলাদেশ আমদানিতে ব্যয় করেছে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীন থেকেই আমদানি হয়েছে ১২ বিলিয়ন এবং ভারত থেকে আমদানি করা হয় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা।
এ ছাড়া বাংলাদেশ এই দুই দেশে পণ্য রপ্তানিও করে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীন, ভারতের সঙ্গে অন্তত আমদানির ২২ বিলিয়ন ডলার স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করা গেলে ডলারের ওপর চাপ কমে যাবে।
চায়না-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় এক হাজার ৩৫৫ কোটি ডলারের বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ৬৮ কোটি ডলার। চীন থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি হয় এক হাজার ২৮৭ কোটি ডলারের।
কী আছে প্রস্তাবে?
এমসিসিআই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ডলারের বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় একটি মুদ্রা বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিশেষ করে যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রচুর পণ্য আমদানি হয় ওই সব দেশের সঙ্গে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের পরামর্শ তাদের। বিশেষ করে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানির জন্য আরএমবি ব্যবহার করার পরামর্শ দেয় সংগঠনটি।
আরএমবি বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যে দ্বিতীয় মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ফলে মার্কিন ডলারের চাহিদা অনেকাংশে কমে আসার পাশাপাশি দেশের জন্য তা স্বস্তিদায়ক হবে। এমসিসিআই প্রতিনিধিদল এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করার পরামর্শ দেয়।
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাতলুব আহমাদ বলেন, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। গত এক দশকে দেশটির সঙ্গে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এখন ১২০০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে প্রায় ২০০ কোটি ডলার।
মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশ পরীক্ষামূলকভাবে ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রুপির ব্যবহার করেও দেখতে পারে ডলারের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে। আমরা মনে করি, ডলারসংকটের এই সময় এতে উভয় দেশ উপকৃত হবে।’ তিনি দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
বিসিসিআইয়ের যুগ্ম মহাসচিব আল মামুন মৃধা আমদানি-রপ্তানি ব্যয় মেটাতে মুদ্রা বহুমুখী করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীনের মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি ব্যয় মেটানো গেলে অনেক বেশি ডলার সাশ্রয় হতো। এতে দুই দেশই উপকৃত হতো। বর্তমান লেনদেনের ক্ষেত্রে টাকা থেকে ডলার এবং ডলার থেকে আরএমবিতে রূপান্তর করতে হয় ব্যবসায়ীদের। বিশ্বের ৪৪টি দেশ আরএমবিতে লেনদেন করে জানিয়ে মামুন মৃধা বলেন, অন্য দেশগুলো কী কৌশল অবলম্বন করেছে তা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারত ও চীন দুই দেশই নিজেদের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করছে। রাশিয়া থেকে রুপি দিয়ে গ্যাস কিনছে ভারত। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে। এটা করা উচিত।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করলেও বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক সমস্যার কারণে এমন উদ্যোগ নিতে পারেনি। তবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে যে ধরনের উদ্যোগ নিলে সংকট থেকে বেরিয়ে আসা যায় তা নেওয়া উচিত।
বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিকল্প মুদ্রা বিনিময়ের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলমও। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সংকট কাটাতে এখন বাটার ব্যবস্থায়ও (পণ্য দিয়ে পণ্য আনা) যাওয়া যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ