নওগাঁ জেলায় অবস্থিত এশিয়ার প্রাচীন ও বৃহত্তম সমবায় সমিতি নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লি: এর অস্থিত্ব প্রায় বিলীনের পথে। গাঁজা মহলের সেই স্বর্নালী দিনগুলি এখন শুধুই যেন এক স্মৃতি। ঠিক মতো দেখভাল করার অভাবে পড়ে রয়েছে সমিতির কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সুযোগ সন্ধানীরা সেই সম্পদের অনেকটাই গ্রাস করে ফেলেছে। মিলবেনা আগের সেই হিসাবের খাতা। স্বেচ্ছাচারিতা, ষড়যন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির গৌরবময় দিনগুলি যেন ধাবিত হচ্ছে ইতিহাসের পাতার দিকে।
এক সময় গাঁজা উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে নওগাঁর বেশ সুনাম ছিল। গাঁজার উৎপাদনকে কেন্দ্র করে শহরে চারটি গুদামঘর তৈরি করা হয়। যে কারণে এলাকাটি ‘গাঁজা গোলা মোড়’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। গড়ে উঠেছে গাঁজা সমবায় সমিতি। শহরজুড়ে ব্রিটিশ আমলের গাঁজা সোসাইটির কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ের পাশে অবস্থিত ‘গাঁজা সমবায় হিমাগার’অন্যতম। তবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও গত দুই বছর ধরে হিমাগারটি ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই এখন স্থায়ীভাবে বন্ধের পথে গাঁজা সোসাইটির এ হিমাগারটি।
নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী (অংশীদার) পুনর্বাসন সমবায় সমিতি অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে হিমাগারটি তৈরি করা হয়েছিল, যা ২০০৪ সাল পর্যন্ত মার্কেটিং সোসাইটির আওতায় ছিল। এরপর ২০০৫ সালে গাঁজা সোসাইটির আওতাভুক্ত হয়।
হিমাগারের তিনটি ঘরে ধারণক্ষমতা প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন। একসময় এটি ছিল জেলার মধ্যে একমাত্র হিমাগার। ২০০৬ সাল থেকে একবছর মেয়াদি ইজারা দেওয়া হতো। প্রতিবছর ৩ লাখ ৩৬ টাকার হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। সর্বশেষ ইজারা দেওয়া হয় বছরে ২ লাখ ১২ হাজার টাকায়। ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শহরের মো. শেখ আল মামুন নামে এক ঠিকাদারের কাছে ইজারা ছিল। ২০২০ সালে হিমাগারটি ইজারা দেওয়ার জন্য গাঁজা সোসাইটি থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় কেউ ইজারা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ফলে দুই বছর থেকে হিমাগারটি বন্ধ রয়েছে। হিমাগারটি দেখভালের জন্য একজন ম্যানেজার, একজন অপারেটর ও দুইজন প্রহরী (নাইটগার্ড) রয়েছেন।
ঠিক মতো দেখভাল করার অভাবে পড়ে রয়েছে সমিতির কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সুযোগ সন্ধানীরা সেই সম্পদের অনেকটাই গ্রাস করে ফেলেছে। মিলবেনা আগের সেই হিসাবের খাতা। স্বেচ্ছাচারিতা, ষড়যন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির গৌরবময় দিনগুলি যেন ধাবিত হচ্ছে ইতিহাসের পাতার দিকে।
গাঁজা সোসাইটির অফিস এখন দেখভাল করেন অফিস সহকারী আনিসুর রহমান। তার তথ্যমতে, সমিতির সম্পত্তির মধ্যে আছে ২৮টি ভবন, একটি হিমাগার, চারটি গোডাউন, একটি সরাইখানা, একটি মিটিং গ্রাউন্ড, তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১১টি উচ্চবিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, একটি মন্দির, সাতটি বড় পুকুর ও একটি লেক। এসব সম্পদ নওগাঁ সদরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শতবছর ধরে নওগাঁর উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে গাঁজা সোসাইটির এসব সম্পদ।
একসময় গাঁজা সোসাইটির হিমাগারটি ছিল জেলার একমাত্র হিমাগার। ১৯৮৭ সালে দেশে গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ করা হলে হিমাগারটি আলুর বীজ রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। তখন এর বেশ চাহিদাও ছিল। ব্যবসায়ী ও কৃষকরা এখানে আলুর বীজ সংরক্ষণ করতেন। তবে জেলায় ব্যক্তিগত হিমাগার তৈরি হওয়ার পর থেকে এটির গুরুত্ব কমতে থাকে।
জেলায় এখন চারটি কোল্ড স্টোরেজ (হিমাগার) রয়েছে। যেখানে আলুর ধারণক্ষমতা প্রায় ৫ লাখ বস্তা। প্রতি বস্তায় আলুর ওজন ৮০-৯০ কেজি। ব্যক্তিগত হিমাগার থেকে চাষিদের আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করতে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু গাঁজা সোসাইটির হিমাগারটির বছর বছর ইজারাদার পরিবর্তন হওয়ায় কোনো ঋণের ব্যবস্থা করা হয় না। তাই দিনদিন এটির গুরুত্ব কমতে থাকে।
হিমাগারটির ভবন ও মেশিনারিজ সরঞ্জাম অনেক পুরোনো। কোনো সংস্কার না হওয়ায় মেশিনের ঠান্ডা ধরে রাখার ক্ষমতা কমে গেছে। এছাড়া মেশিনটি পুরোনো হওয়ায় বিদ্যুৎ বিলও বেশি আসে। একারণে হিমাগারটি ইজারা নিতে কেউ তেমন আগ্রহ দেখান না। এদিকে, হিমাগারটি বন্ধ থাকায় অনেক সরঞ্জাম মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গাঁজা সোসাইটির মূল্যবান সম্পদ এ হিমাগারটি এখন স্থায়ীভাবে বন্ধের পথে।
১৯৮৭ গাঁজা নিষিদ্ধ হলে ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ সাল এই দীর্ঘ সময়ে জীবন জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন জন বেছে নিয়েছে বিভিন্ন পেশা। সম্প্রতি নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লি: তাদের সম্পত্তির বিভিন্ন স্থানে মার্কেটসহ ভবন নির্মাণ শুরু করেছে। অনেকেই জবর দখল করে রেখেছে বেশকিছু জায়গা ও ভবণ। কিন্তু এই সমিতির প্রকৃত সমবায়ীরা তাদের নায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। অথচ নওগাঁ যখন ১৯৮৪ সালের ১লা মে নওগাঁ মহকুমা জেলায় রুপান্তরিত হয় তখন সরকারী অফিস আদালত গুলো গাঁজা ভবন গুলিতেই অফিস স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। পরর্বতীতে সরকারী ভবন নির্মাণ হলে অফিস গুলো স্থানান্তর করা হয়। পরিত্যক্ত ফাঁকা ভবনগুলি অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ে। চলে যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহলের দখলে ।
গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লি: যে বিশাল সম্পদ রয়েছে তা সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার মাধ্যমে সমবায়ীদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। গাঁজা চাষকে কেন্দ্র করে নওগাঁ শহর রুপান্তরিত হয়। শহরের প্রাচীন ভবন বলতে নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লি: এর ভবনগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। বহু উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে এখনো কোনভাবে টিকে আছে সমিতিটি। এই সমিতির কার্যক্রমে অভিযোগের শেষ নেই। আদালতে অগুনতি পাল্টা পাল্টি মামলা রয়েছে। বহু রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি সমিতির বাসভবন গুলি নামমাত্র ভাড়ায় নিজেদের আয়ত্বে রেখেছেন।
১৯৭৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে মাদকদ্রব্য বিরোধী চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী ১০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের মধ্যে গাঁজা চাষ বন্ধের শর্ত ছিল। শর্ত মোতাবেক ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে গাঁজা চাষ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম ও বৃহত্তম সমবায় প্রতিষ্ঠান নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লি: এর ৭ হাজার সমবায়ী পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ কর্মসংস্থানের অভাবে চরম বিপাকে পড়ে।
বংশ পরম্পরায় চলে আসা প্রায় ২শ’ বছরের প্রাচীন পেশার মানুষগুলোর সামনে ছিলনা কোন কাজের নির্দেশনা। কাঁশার থালায় হাতের কব্জি ডুবিয়ে দুধভাত খাওয়ায় অভ্যস্ত মানুষগুলি দিন দিন কষ্টে জীবন যাপন করতে শুরু করেছে। ধান, সরিষা, সবজি তাদের কাছে তখন নতুন ফসল হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু গাঁজা চাষ আর ফসল চাষের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
বিশ্বে আবার চাহিদা শুরু হয়েছে গাঁজার। কারণ গাঁজার ওষুধি অপরিসীম গুনাগুন। সাম্প্রতিক কালে একের পর এক দেশে গাঁজাকে বৈধ ঘোষান করা হচ্ছে। খবরে জানা গেছে বৃটিশ পার্লামেন্ট গাঁজা থেকে মরফিন উৎপাদরে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। এবং বৃটিশ সরকার বাংলাদেশের গাঁজা উৎপাদনে উৎসাহ দেখিয়েছেন। এ ছাড়াও থাইল্যান্ডে গাঁজার বৈধতা দেওয়া হয়েছে বলেও খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশে বৈধভাবে গাঁজা চাষ ও বিপননের অনুমতি প্রদানন করা হলে এই অর্থকারি ফসল থেকে লদ্ধ আয়ের দ্বারা বাংরাদেশ পৃথীবির মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৯
আপনার মতামত জানানঃ