নড়াইলে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কলেজ অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার জের এখনো কাটেনি। এর মধ্যেই এবার নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, দোকান ও মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল শুক্রবার এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার সূত্রপাত দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় ১৮ বছর বয়সী এক কলেজ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে।
গতকাল জুমার নামাজের পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নজরে বিষয়টি আসার পর ওই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে তার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার জুমার নামাজের পর গুজব ছড়িয়ে পরে দীঘলিয়া সাহাপাড়ার কলেজছাত্র আকাশ সাহা (২২) ফেসবুকে নবী মোহাম্মদকে নিয়ে কথিত কটূক্তি করেছেন। এরপর বিক্ষুব্ধ লোকজন আকাশ সাহার গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে তাদের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করেন। পরে বিকেলে উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে। বিক্ষুব্ধ লোকজন একপর্যায়ে সাহাপাড়ার গোবিন্দ সাহা, তরুণ সাহা, দিলীপ সাহা, পলাশ সাহাসহ পাঁচ-ছয়টি বাড়ি ভাঙচুর করে। এর মধ্যে গোবিন্দ সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া সাহাপাড়ার মন্দিরের চেয়ার ও সাউন্ডবক্স ভাঙচুরসহ সেখানে ইট ছুড়েছে বিক্ষুব্ধরা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়।
গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ ওই শিক্ষার্থীর বাবাকে বাড়ি থেকে পুলিশ হেফাজতে নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
গতকাল উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়েছে বলে জানান এলাকাবাসী ও পুলিশ।
বিক্ষুব্ধ লোকজন একপর্যায়ে সাহাপাড়ার গোবিন্দ সাহা, তরুণ সাহা, দিলীপ সাহা, পলাশ সাহাসহ পাঁচ-ছয়টি বাড়ি ভাঙচুর করে। এর মধ্যে গোবিন্দ সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া সাহাপাড়ার মন্দিরের চেয়ার ও সাউন্ডবক্স ভাঙচুরসহ সেখানে ইট ছুড়েছে বিক্ষুব্ধরা।
দিঘলিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য প্রভাত কুমার ঘোষ বলেন, ‘ফেসবুকে ওই ছেলের বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও মন্দিরে হামলা চালিয়েছে। তারা একটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।’
লোহাগড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারান চন্দ্র পাল বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শটগান থেকে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বিষয়টি মীমাংসায় কাজ করে যাচ্ছেন। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তবে ওই শিক্ষার্থী পলাতক। তাকে আটকের চেষ্টা চলছে।’
আজ পর্যন্ত ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি।
লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজগর আলী বলেন, ‘অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে আমরা এখনো পাইনি। তাই তার পোস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। এটি কোনো সংগঠিত হামলা নয়। দিঘলিয়া একটি বড় বাজার হওয়ায় এটি একটি বিচ্ছিন্ন হামলা। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। মন্দিরে কিছু ইট-পাটকেল ছোড়া হয়েছে।’
গত ১৭ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্র ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত এক বক্তব্য নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পরদিন কলেজে গেলে কিছু মুসলমান ছাত্র তাকে ওই পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন।
এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস পুলিশে খবর দেন।
ওই সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে আসে, যাতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়।
এ নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদ উঠলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে কয়েকদিন পরপরেই শোনা যায় কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা। ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আপেক্ষিক। এরপরেও যদি কেউ মনে করে যে কোন ঘটনা তার ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেছে; তাহলে দেশের আইন আদালত সব আছে, তিনি আইনের দারস্থ হতে পারেন। কিন্তু গত কয়েকটি দশকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে বিভিন্ন সময়ে কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্মমভাবে আক্রমণসহ তার ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টিতে দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাকস্বাধীনতা দিনেদিনে হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুভূতি বলতে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিতেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা প্রচণ্ড একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি দেখি। সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ থেকে যদি কারও নামে ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ করা হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিটি অপরাধ করেছেন কি করেননি এটা যাচাই না করেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাকে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি যদি সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। বিষয়টি দিনে দিনে সংখ্যালঘুদের কাছে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ