ভারতে গণহত্যার ঘটনা ঘটার ঝুঁকি রয়েছে। এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন দূত রাশাদ হুসেন।
গণহত্যার ঝুঁকি রয়েছে, এমন দেশের তালিকায় ভারত দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তার বক্তব্য, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্বের যাবতীয় ‘উপকরণ’ রয়েছে ভারতে। রাশাদ জানান, আমেরিকা নিজেদের উদ্বেগ নিয়ে সরাসরি ভারতের সাথে কথা বলছে।
ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার একটি প্যানেলে বক্তৃতা রাখার সময় মার্কিন এ কর্মকর্তা বলেন, হলোকাস্ট মিউজিয়ামের ‘আর্লি ওয়ার্নিং প্রজেক্ট’ (প্রারম্ভিক সতর্কীকরণ প্রকল্প) ভারতকে গণহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে।
তিনি নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের উল্লেখ করেন। পাশাপাশি খুলে আম ‘গণহত্যার আহ্বান’-এর উল্লেখও করেছেন নিজের বক্তৃতায়।
তিনি বলেন, ‘আমরা গীর্জার উপর হামলা দেখেছি, ঘরবাড়ি ধ্বংস হতে দেখেছি; হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; এমন সব বক্তব্য প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে যা মানুষের প্রতি খুবই অমানবিক। দেশের একজন মন্ত্রী মুসলমানদেরকে উইপোকা বলে উল্লেখ করেছেন।’
রাশাদ হুসেন বলেন, যেকোনো সমাজকে মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, দলিত ও উপজাতিদের অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হলো এমন একটি দেশ, যেখানে আমাদের দেশের মতোই, আমরা জোর দিই, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে আমরা আমাদের মূল্যবোধ অনুযায়ী বাঁচি যাতে আমরা আমাদের সম্ভাবনা পূরণ করতে পারি। এটা তখনই ঘটতে পারে যদি আমাদের পূর্ণ অংশগ্রহণ থাকে, সকল মানুষের সমান অংশগ্রহণ থাকে।’
এর আগে রাশাদের দফতর ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল যা প্রকাশ করেছিলেন মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্তনি ব্লিনকেন। সেই রিপোর্টে ভারতে ‘মানুষ ও উপাসনালয়ের উপর ক্রমাগত হামলার’ প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছিল। যদিও ভারত সেই রিপোর্ট খারিজ করে দিয়ে এটিকে ‘ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি’ বলে উল্লেখ করেছিল।
এবারই প্রথম নয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক গ্রেগরি স্ট্যান্টন মার্কিন কংগ্রেসের ব্রিফিংয়ের সময় বলেছিলেন যে ভারতের আসাম এবং ভারত-শাসিত কাশ্মীরে গণহত্যার প্রাথমিক “লক্ষণ এবং প্রক্রিয়া” রয়েছে। আমরা সতর্ক করছি যে ভারতে গণহত্যা খুব গুরতরভাবেই ঘটতে পারে।
এর আগে ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় টাটসিদের উপর যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তার কয়েক বছর আগে সতর্ক করে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এই বিশেষজ্ঞরাই।
অপরাধের, প্রতিরোধ, ভবিষ্যদ্বাণী এবং জবাবদিহিতা চাওয়ার জন্য ১৯৯৯ সালে তিনি যে বেসরকারি সংস্থা চালু করেছিলেন তার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে এসব তথ্য তুলে ধরেন৷
স্ট্যান্টন বলেছিলেন যে গণহত্যা একটি ঘটনা নয় বরং একটি প্রক্রিয়া। এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুসৃত নীতি। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারও বৈষম্যমূলক এই নীতির প্রয়োগ করে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে নীতিগুলি উদ্ধৃত করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল ২০১৯ সালে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা প্রত্যাহার করা। যা কাশ্মীরীদের সাত দশক ধরে তাদের বিশেষ স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিয়েছিল এবং একই বছর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে মুসলিমদের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়।
ভার্জিনিয়ার জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির “গণহত্যা অধ্যয়ন এবং প্রতিরোধ” বিষয়ের প্রাক্তন লেকচারার স্ট্যান্টন বলেছেন, তিনি মিয়ানমারের অনুরূপ পরিস্থিতি ভারতে আশঙ্কা করছেন, যেখানে রোহিঙ্গাদের প্রথমে আইনত অ-নাগরিক ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তারপরে সহিংসতা ও গণহত্যার মাধ্যমে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল।
স্ট্যান্টন বলেছিলেন যে হিন্দুত্ব মতাদর্শ “ভারতের ইতিহাস এবং ভারতীয় সংবিধানের বিপরীত। আর মোদী একজন চরমপন্থী, যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি অবশ্যই ভারতে হিন্দুত্ব কায়েম করতে চাইবেন।
তিনি আরও বলেন, ভারতে যা হচ্ছে তা পুরোপুরি মিয়ানমারের গণহত্যার পূর্বের ঘটনাগুলির প্রতিচ্ছবি।
স্ট্যান্টন জানান, ১৯৮৯ সালে তিনি রুয়ান্ডার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জুভেনাল হাবিয়ারিমানাকে সতর্ক করে বলেছিলেন যে, “আপনি যদি আপনার দেশে গণহত্যা প্রতিরোধে কিছু না করেন তবে পাঁচ বছরের মধ্যে এখানে একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হবে। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে ৮,০০,০০০ টাটসির গণহত্যা করা হয় রুয়ান্ডায়।
স্ট্যান্টন বলেন, “আমরা ভারতে এটা হতে দিতে পারি না।” জেনোসাইড ওয়াচ ২০০২ সালে ভারতে গণহত্যার বিষয়ে সতর্ক করেছিল, কিন্তু তখন পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যে তিনদিনের আন্তঃসাম্প্রদায়িক সহিংসতার ফলে এক হাজার জনেরও বেশি মুসলমান নিহত হয়।
বেঙ্গালুরুর মানবাধিকার কর্মী, লেখক এবং ভারতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন প্রধান আকার প্যাটেল আল জাজিরাকে বলেছেন যে, প্রতিবেদনগুলিকে “খুব গুরুত্ব সহকারে” নেওয়া উচিত।
প্যাটেল বলেছিলেন, আমি মনে করি ভারতের সহিংসতার রেকর্ডের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, রাজ্য সরকার এমন কিছু করে যা সহিংসতাকে (মুসলিমদের বিরুদ্ধে) উস্কে দেয় বা তারা এটি বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট কাজ করে না।
তিনি আরও বলেন, ডানপন্থী হিন্দু দলগুলোর নেতারা অনেক সময় জনসভায় মুসলিমদের উপর নির্যাতনের আদেশ দিয়ে থাকে। যা সারা পৃথিবীর মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিকদের বিব্রত করে। আমি মনে করি ভারত সরকারের এটিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞরা হিন্দু আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা মুসলিম বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের নিন্দা করেছেন।
নভেম্বরে হিন্দু কট্টরপন্থীরা একজন মুসলিম প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘সালমান খুরশিদের’ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, মোদির অধীনে যে ধরনের হিন্দু জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করেছে তা আইএসআই এর মতো “চরমপন্থী গোষ্ঠীর” সাথে তুলনা করেছিলেন অনেকে।
গত মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের গণহত্যা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহারের আহ্বান জানানো ভিডিওগুলির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট উত্তরাখণ্ড রাজ্যে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
আল জাজিরার একজন সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদ অপূর্বানন্দ এটি বলেছেন, বিজেপির নেতৃত্বে ভারত বিশ্বের মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে। তারা শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।
তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি, খাদ্যাভ্যাস এবং এমনকি ব্যবসাকে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করতে আইন পাস করা হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকারের মুখপাত্র সৈয়দ জাফর ইসলাম জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, যেভাবে দেখানো হয়েছে তার কোনটিই সঠিক নয়।
ইসলাম বলেন, প্রথমত তারা যে ধারণা তৈরি করেছে তা বাস্তবিকভাবে ভুল। তিনি বলেন মিডিয়া দ্বারা হাইলাইট করা অনেক ঘটনা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদির বিজেপির বিরুদ্ধে কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিপীড়ণকে উৎসাহিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও এই অভিযোগগুলি অস্বীকার করে আসছে তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩৩
আপনার মতামত জানানঃ