ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে সোমবার (২৭ জুন) গ্রেপ্তার করেছে দিল্লি পুলিশ। বাকস্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিরা এই উদ্যোগের নিন্দা জানিয়েছেন।
মোহাম্মদ জুবাইর তথ্য যাচাইয়ের (ফ্যাক্ট চেকিং) ভারতীয় ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের সহপ্রতিষ্ঠাতা। তাকে নয়াদিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, মোহাম্মদ জুবাইর হিন্দুদের দেবতা হমুমানকে নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছিলেন।
গ্রেপ্তারের কারণ হিসেবে দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টুইটারে ২০১৮ সালে করা একটি পোস্টের জের ধরে জুবায়েরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। সেই মামলার তদন্তের স্বাপেক্ষে জুবায়েরকে ডাকা হয়েছিল। উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর আগে ভারত সরকার টুইটার কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে বলেছে, মোহাম্মদ জুবাইর তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ভারতীয় আইন লঙ্ঘন করে পোস্ট করেছেন। জুবাইরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের পাঁচ দিনের মাথায় তাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
তবে জুবাইরকে গ্রেপ্তারের আগে পুলিশ কোনো নোটিশ দেয়নি বলে জানিয়েছেন অল্ট নিউজের আরেকজন সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা। তিনি টুইটার পোস্টে বলেছেন, বুরারিতে একটি পুলিশ বাসের মধ্যে তাকে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়।
প্রতীক সিনহা আরও জানান, ডাক্তারি পরীক্ষার পর জুবাইরকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি কিংবা জুবাইরের আইনজীবী—কেউ তার খোঁজ জানেন না।
মোহাম্মদ জুবাইর একজন সাবেক টেলিকম প্রকৌশলী। বাস করতেন বেঙ্গালুরুতে। আর প্রতীক সিনহা একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী। তার বাড়ি আহমেদাবাদে। দুজন মিলে ২০১৭ সালে অল্ট নিউজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওয়েবসাইটটি অসংখ্য ভুয়া খবরের সত্যতা যাচাই করেছে।
অল্ট নিউজ দাবি করেছে, বেশির ভাগ ভুয়া খবর ছড়াত ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থকেরা।
এসব কাজের জন্য জুবাইর ও সিনহা বছরের পর বছর পুলিশে মামলার শিকার হয়েছেন।
দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র সুমন নালওয়া আল-জাজিরাকে জুবাইরের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, জুবাইরের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ ধারা (দাঙ্গা সৃষ্টির অভিপ্রায়ে উসকানি দেওয়া) এবং ২৯৫-এ ধারায় (ইচ্ছাকৃত এবং বিদ্বেষমূলক কাজ, যা ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে) অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, জুবাইরকে গ্রেপ্তার করায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ বেশ কয়েকজন বিরোধীদলীয় নেতা।
রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘বিজেপির ঘৃণা, ধর্মান্ধতা এবং মিথ্যাচার প্রত্যেক মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি সত্যকণ্ঠকে গ্রেপ্তার করা মানে আরও হাজার হাজার সত্যকণ্ঠের জন্ম দেওয়া।’
মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, দিল্লি পুলিশের সাইবার অপরাধ দলের উপ-কমিশনার কেপিএস মালহোত্রা জানান, ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ জুবায়েরকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
অল্ট নিউজ ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত মিথ্যে তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে থাকে।
উপ-কমিশনার মালহোত্রা জানান, জুবায়েরকে ভারতের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি’ রক্ষা সংক্রান্ত ২টি ধারার আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিজেপির ঘৃণা, ধর্মান্ধতা এবং মিথ্যাচার প্রত্যেক মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। একটি সত্যকণ্ঠকে গ্রেপ্তার করা মানে আরও হাজার হাজার সত্যকণ্ঠের জন্ম দেওয়া।’
জুবায়ের প্রায়ই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমালোচনা করে টুইট করেন। দেশটির ২০ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর অধিকারের ওপর আঘাত এলেই তিনি এ ধরনের বার্তা প্রকাশ করেন বলে দাবি করেছেন জুবায়ের এবং সমমনা অন্যান্য সমালোচকরা।
এমন সময়ে তিনি গ্রেপ্তার হলেন, যখন সমালোচকরা বারবার দাবি করছেন, বিজেপি ঔপনিবেশিক আমলের কিছু আইন ব্যবহার করে যেকোনো ধরনের সমালোচনার পথ রুদ্ধ করছে।
জুবায়েরের আইনজীবী কাওয়ালপ্রীত কাউর জানান, তাকে ২০২০ সালের একটি ফৌজদারি তদন্তের জের ধরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট দেওয়া সংক্রান্ত সে মামলায় দিল্লির হাইকোর্ট তাকে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে সুরক্ষা দিয়েছিল। কাউর জানান, কিন্তু তিনি (জুবায়ের) যখন আদালতের সমনের উত্তর দেন, তখন পুলিশ তাকে ভিন্ন একটি মামলায় গ্রেপ্তার করলো।
কাউর আরও জানান, একজন টুইটার ব্যবহারকারী ২০১৮ সালে জুবায়েরের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনেন।
আইনজীবী কাউর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন না করা ও জুবায়েরকে কোনো নোটিশ না পাঠানোর অভিযোগ আনেন।
জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করায় রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সংবাদ সংস্থা নিন্দা ও তার মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্য ও অধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান ওরফে সামি তার এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারনে জুবায়ের’কে গ্রেফতার করা গেলে নূপুর শর্মা এখনো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? তাকে বুঝি গ্রেফতারে মানা নাকি তিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে ব্যার্থ হয়েছেন?
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘাতপ্রবণ এলাকার বাইরে সংবাদকর্মীদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। তবে ভারতের সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা ও মামলার ঘটনা অনেকটা নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
২০২১ সালে দেশটিতে ১২১ জন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে অন্তত ৬ সাংবাদিককে। ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নকারী সংস্থা রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালিসিস গ্রুপ (আরআরএজি) এ তথ্য জানিয়েছে।
এই প্রতিবেদনে ভারতজুড়ে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর নানামুখী আক্রমণের চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছর ভারতে ১০৮ জন সাংবাদিক ও ১৩টি সংবাদমাধ্যম আক্রমণের শিকার হয়েছে।
মোদীর শাসনকালে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতই স্বৈরাচারী, এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ। কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ায় এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ হওয়ায় ভারতের এই অবনতি হয়েছে। মোদীর বিভিন্ন নীতিসমূহ ভারতে মুসলিম-বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিয়েছে, এবং তা ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দ্রুত কমছে। সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রাখার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে সরকার ও কর্তৃপক্ষ ক্রমশ অগ্রাহ্য করছে। কেউ তাদের সমালোচনা করলেই হেনস্তা করা হচ্ছে। দেশদ্রোহের নামে সাংবাদিকদের জেলে পোরা হচ্ছে, অসংখ্য মামলার জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য এটা বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩১
আপনার মতামত জানানঃ