শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সঙ্কটের পটভূমিতে সে দেশের মন্ত্রিসভা সরকারি কর্মচারীদের জন্য তিন দিনের সাপ্তাহিক ছুটির এক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এখন থেকে সপ্তাহে চার দিন কর্মদিবস হতে যাচ্ছে।
আজ মঙ্গলবার(১৪ জুন) শ্রীলঙ্কার সরকার সাপ্তাহিক কর্মদিবস কমানোর কথা জানায়। এ বিষয়ে দেশটির মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশে চলমান জ্বালানিসংকট মোকাবিলা এবং সরকারি কর্মচারীদের চাষাবাদে উৎসাহিত করতে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশটি। আগামী তিন মাস এই ছুটির ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে।
তবে স্বাস্থ্য, পানি, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাত এর আওতামুক্ত থাকবে। খবর বিবিসি, রয়টার্স ও কলম্বো পেজের।
সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী দিশে গুনাবর্ধন জানিয়েছেন, শনি এবং রবিবার ছাড়াও সরকারি কর্মচারীরা শুক্রবার অতিরিক্ত ছুটি ভোগ করবেন। এই একদিনের জন্য তাদের বেতন দেওয়া হবে।
তবে স্বাস্থ্য, জ্বালানি, শিক্ষা এবং প্রতিরক্ষাসহ জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিত কর্মচারীরা এই ছুটি পাবেন না।
শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে দেশটি এখন হিমশিম খাচ্ছে।
পেট্রোল পাম্পগুলোর সামনে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। একারণে শ্রীলঙ্কার গণ-পরিবহন খাতও বিপর্যস্ত হয়েছে।
দেশটিতে সরকারির কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। কিন্তু কয়েক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট চলছে দেশটিতে। কয়েক মাস ধরে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এতে করে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের মতো জরুরি পণ্যগুলোও আমদানি করতে পারছে না দেশটির সরকার।
শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে অনেকেই জ্বালানির জন্য দীর্ঘ সময় পেট্রলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে তাদের। মুদ্রার মান কমে যাওয়া, বিশ্বজুড়ে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও সার আমদানি নিষিদ্ধে (এখন প্রত্যাহার হয়েছে) এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫৭ শতাংশ।
গতকাল সোমবার শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী তিন মাস সরকারি খাতের কর্মচারীরা শুক্রবার ছুটি পাবেন। কারণ হিসেবে চলমান জ্বালানিসংকটে মানুষের চলাচলে অসুবিধা এবং একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের চাষাবাদে উৎসাহিত করতে ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানায় সরকার।
সরকারের তথ্য বিভাগ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে এ কথা জানানো হয়। তাতে বলা হয়, ‘সরকারি কর্মচারীদের ছুটি আরও এক দিন বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। এখন থেকে শনি ও রোববারের সঙ্গে শুক্রবারও সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে গণ্য হবে। এতে করে সরকারি কর্মচারীরা তাদের বাড়ির পাশে বা অন্যত্র চাষাবাদের কাজ করার সুযোগ পাবেন, যা দেশে খাদ্যসংকটের একটা সমাধানও হতে পারে।
চলমান জ্বালানিসংকটে মানুষের চলাচলে অসুবিধা এবং একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের চাষাবাদে উৎসাহিত করতে ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানায় সরকার।
শ্রীলঙ্কায় মানবিক সংকট আরও খারাপের দিকে যাওয়া নিয়ে গত সপ্তাহে সতর্ক করে জাতিসংঘ বলেছে, চরম সংকটে আছেন এমন ১০ লাখ মানুষকে সাহায্যের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কাকে ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে তারা। এ ছাড়া ঋণ ছাড়ের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার আলোচনা চলছে।
শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সারের অভাবে ফসল ফলাতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
শ্রীলঙ্কায় কৃষকদের জন্য আগামী কৃষি মৌসুমে যথেষ্ট পরিমাণ সার আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। তবে এবারের মৌসুমের জন্য কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি। বরং চরম অর্থনৈতিক সংকটের জেরে দেশটিতে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
গত বছরের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে রাসায়নিক সার আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এর জেরে দেশটিতে কৃষি উৎপাদন অনেক কমে যায়। এ অবস্থান থেকে সরে আসছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল। গত বৃহস্পতিবার টুইটে তিনি বলেন, ‘চলতি ইয়ালা মৌসুমের (মে থেকে আগস্ট) প্রয়োজনীয় সার কেনার সময় আর নেই। তবে আসন্ন মাহা (সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ) মৌসুমে সারের সংকট থাকবে না। আমি আন্তরিকভাবে সবাইকে এই সংকটের গভীরতা বোঝার অনুরোধ করছি।’
খাদ্যসংকটে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কা আরও বেশি অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি দেশটি স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন খাদ্যশস্য–সংকটেও পড়ে যেতে পারে। শ্রীলঙ্কা কাউন্সিল ফর অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ পলিসির প্রেসিডেন্ট গামিনি সেনানায়েকে বলেন, ‘খাদ্যের দিক থেকে আগামী কয়েক মাস খুব কঠিন সময় আসবে। খাদ্যসংকট দেখা দেবে। আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’
চাপের মুখে গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেছেন মাহিন্দা। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন বিরোধী দলীয় নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে। তবে তিনি রাজাপাকসে ভাইদের ‘হাতের পুতুল’ বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারিতে পর্যটন খাত থেকে আয় শূন্যে নেমে যাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং জনগণের মন জয় করতে রাজাপাকসে সরকারের কর কর্তন শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫২
আপনার মতামত জানানঃ