দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সমালোচনার পরও বাংলাদেশে বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা কমছে না৷ সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানা হেফাজতে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভয়ঙ্কর পুলিশি নির্যাতনের শিকার নিরপরাধ রাজীবের রাত কাটে এখনো নির্ঘুম। ঘুমালেই হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন। স্বপ্নে দেখে পুশিল তাকে নির্মম নির্যাতন করছে, মেরে ফেলতে তেড়ে আসছে। তিন বছর আগে ঢাকার কোতয়ালি থানায় ভয়ঙ্কর পুলিশি নির্যাতনের শিকার স্বর্ণ ব্যাবসায়ি রাজিব কর রাজু এভাবেই নিজের বর্তমান অবস্থার কথা জানান। তিনি জানান, নির্যাতনে তিনি কেবল কর্মক্ষমতাই হারাননি, হয়েছেন সর্বশান্তও।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়া সাদা পোশাকে ভিকটিমের ৬৯ নং গোয়ালনগর কোতয়ালীর বাসায় সিলিং ভেঙে প্রবেশ করেন। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আসামিরা ভিকটিম রাজুকে হাতকড়া পরিয়ে চড়-থাপ্পর মারতে থাকেন।
এ সময় ভিকটিমের বাসা তল্লাশি করে ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৮ টাকার স্বর্ণ এবং তার মায়ের চোখ অপারেশন করার ৪১ হাজার ৩০০ টাকা ছাড়াও বাসা থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ কোতয়ালী থানায় নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে আসামিরা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান। নির্যাতনে ভিকটিম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা শেষে আসামিরা তাকে আবার থানায় নিয়ে আসেন এবং ৫ লাখ টাকা দিতে বলেন। না হলে অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামি বানিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দেন।
টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে আবারও নির্যাতন করেন আসামিরা। পরবর্তীতে ভিকটিমের পরিবার দুই দফায় দুই লাখ টাকা দেন আসামিদের। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে ভিকটিম প্রায় এক বছর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
এ বিষয়ে ভিকটিম কোতয়ালী থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নিয়ে তাকে ঘোরাতে থাকেন। আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে বিচার প্রার্থনা করেন বলে আর্জিতে উল্লেখ করেন ভিকটিম। থানা কর্তৃপক্ষ মামলা ৮না নেওয়ায় আদালতে এ মামলা করেন রাজীব কর রাজু।
আসামিরা হলেন— কোতয়ালী থানার এসআই মিজানুর রহমান ও জলিল এবং এ এসআই ফরিদ ভূঁইয়া।
পুলিশ কীভাবে হুমকি দিচ্ছে, জানতে চাইলে রাজীব কর বলেন, তার এই অভিযোগ পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, পুলিশের ওয়ারী বিভাগ ও রাঙামাটি জেলা পুলিশ তদন্ত করেছে। এখন করছে পিবিআই। তদন্ত চলার সময়ই এসআই মিজানুর তাকে বলেন, এত হাঙ্গামা হবে জানলে আর রাজীবকে বাঁচিয়ে রাখতেন না। পিবিআই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে, রাজীব করও সঙ্গে যান। তখন স্থানীয় লোকজন বলেন, পুলিশ নিয়মিত তাঁর খোঁজে বাসায় যায়। দুটি মুঠোফোন নম্বর থেকেও ফোন করে মিটমাট করার জন্য জোরাজুরি করা হচ্ছে। পুলিশ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে—এমনও বলা হচ্ছে।
তদন্ত চলার সময়ই এসআই মিজানুর তাকে বলেন, এত হাঙ্গামা হবে জানলে আর রাজীবকে বাঁচিয়ে রাখতেন না।
ওই দুই মোবাইল ফোন নম্বরের একটি ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের। অন্যটি লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মুহিত কবিরের সরকারি নম্বর। মামলা মিটমাটের জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করে মুহিত কবির প্রথম আলোকে বলেন, রাজীব কর অভিযোগ করেছেন তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কে কীভাবে হুমকি দিচ্ছে জানতে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
মামলায় যে তিনজনকে আসামি করা হয়েছে, তাদের খুদে বার্তা পাঠিয়ে ফোন করা হয়। সাড়া পাওয়া গেছে শুধু উপপরিদর্শক মো. জলিলের। তিনি বলেন, তার নামে কোনো মামলা হয়েছে কি না, সে খবর জানেন না। তার সঙ্গে পিবিআই কথা বলেনি।
রাজীব কর প্রথম আলোকে বলেন, তাকে নির্যাতনের খবর জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে গুজব রটানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তিনি ভারতীয় এক নাগরিকের কাছ থেকে সোনা কেড়ে নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই নাগরিককে পুলিশ হাজির করতে পারেননি। এমনকি পুলিশ তার নামে কোনো মামলাও করেনি। কেন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, সে সম্পর্কে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।
ঘটনার পর বছরখানেক অসুস্থতার কারণে রাজীব কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়ে চিঠি দেন। তবে ঢাকায় আর পাকাপাকিভাবে ফিরতে পারেননি। এখন পর্যন্ত তিনি স্বর্ণালংকার ও টাকা ফেরত পাননি।
উল্লেখ্য, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন–২০১৩তে এখন পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১টিতে নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা চেপে যান বা আপস করে ফেলেন। তবে রাজীব কর বলেছেন, তিনি এই মামলা তুলবেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ