দেশজুড়ে চলমান ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও বিক্ষোভের মুখে অবশেষে পদত্যাগ করলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। সোমবার তিনি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের দপ্তরে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
এর আগে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, দেশের জন্য যে কোনো আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত রয়েছেন। শ্রীলঙ্কান গণমাধ্যম ডেইলি মিরর অনলাইনের এক প্রতিবেদনে তার পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
দেশটির রাজধানী কলম্বোয় সরকারবিরোধী একটি বিক্ষোভস্থলে হামলার পর পদত্যাগ করলেন প্রধানমন্ত্রী।
এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে যে, কিছু সময় আগেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। দেশজুড়ে চলমান বিক্ষোভের কারণে ফের কারফিউ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যেই তার পদত্যাগের খবর সামনে এলো। রাজধানী কলম্বো এবং দেশের অন্যান্য শহরে সরকারপন্থি লোকজনের সঙ্গে সরকারবিরোধীদের সংঘর্ষ চলছে। সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভ দিন দিন আরও জোরালো হওয়ায় গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের শীর্ষ নেতাদের পদত্যাগের চাপ বাড়তে শুরু করে।
এর আগে গত শুক্রবার দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে জানিয়েছিলেন যে, তার ভাই অর্থাৎ দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে সম্মতি জানিয়েছেন।
গত এপ্রিল থেকে দেশটিতে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এর জেরে দেশটিতে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। এর অংশ হিসেবে সোমবার প্রেসিডেন্ট দপ্তরের সামনে সরকারবিরোধীরা বিক্ষোভ করছিল। একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকশত সমর্থক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার সরকারি বাসভবনের সামনে সমাবেশ করছিল। এরপর সেখান থেকে মিছিল করে গিয়ে প্রেসিডেন্ট দপ্তরের সামনে অবস্থানরত সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
শ্রীলঙ্কায় সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। নির্বাচনকে সামনে রেখে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। এটাকে তখনকার সরকার নির্বাচনী কৌশল হিসেবেই ধরে নিয়েছিল।
সে সময়ে অর্থমন্ত্রী মঙ্গলা সামারাবিরা মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করা ও অন্যান্য শুল্ক বাতিল করার বিপজ্জনক প্রতিশ্রুতির বিষয়ে একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছিলেন।
অর্থনৈতিক সংকটে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রাজাপাকসের পরিবার। হিমশিম খাচ্ছেন মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটাতে। ঋণের জন্য শরণাপন্ন হচ্ছেন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, চীন ও ভারতসহ অন্যান্য দাতাদের কাছে। এরই মধ্যে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দেশটি। যা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ঘটনা। দেশের শেয়ারবাজারও শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে।
গত ২০ বছরের মধ্যে ১২ বছরই শ্রীলঙ্কার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা। এসময় তারা স্বৈরতন্ত্রের তকমা পেয়েছেন। এর আগে তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তার অন্য দুই ভাই দেশটির বন্দর ও কৃষি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এভাবে পাকসে পরিবারের কয়েক ডজন সদস্য সরকারের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশে পর্যটক কমে যাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তিনি স্বীকার করেছেন যে জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, পর্যটকদের অনুপস্থিতির ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়াও বিদ্যমান অর্থনৈতিক দুর্দশার ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশটির রাজধানী কলম্বোয় সরকারবিরোধী একটি বিক্ষোভস্থলে হামলার পর পদত্যাগ করলেন প্রধানমন্ত্রী।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন আন্দোলনকারীরা।
গত মাসের শুরু থেকে চলছে এ আন্দোলন। দ্বীপরাষ্ট্রটির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সরকারকে দায়ী করে গোটা দেশেই চলছে এ আন্দোলন। দেশটির সরকারকে হটাতে এবার আন্দোলন শুরু হলো অনলাইনেও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ চেয়ে অনলাইনে আবেদন করা হচ্ছে দেশটির নাগরিকদের পক্ষ থেকে।
শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যম দ্য আইল্যান্ড–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক বরাবর পাঠানো হয়েছে একটি আবেদন। সেভ শ্রীলঙ্কা নামের ওই অনলাইন আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা শ্রীলঙ্কাকে দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ ছাড়া খারাপ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতির কথাও উল্লেখ রয়েছে এ আবেদনে।
ওই অনলাইন আবেদনে শ্রীলঙ্কার দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। এই সংকট মোকাবিলায় দেশটির সরকার বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে অতিরিক্ত ঋণ পাওয়ার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ২০ বছরের মধ্যে ১২ বছরই শ্রীলঙ্কার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা। এসময় তারা স্বৈরতন্ত্রের তকমা পেয়েছেন। এর আগে তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তার অন্য দুই ভাই দেশটির বন্দর ও কৃষি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এভাবে পাকসে পরিবারের কয়েক ডজন সদস্য সরকারের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা গেছে, রাজাপাকসে ক্ষমতা গ্রহণের আগেও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকটে ছিল। তারপরও নতুন সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। সব মিলিয়ে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায়।
দেশটির অর্থনীতিতে প্রথম ধাক্কা আসে করোনা মহামারির পর। এসময় বিশ্বব্যাপী জারি হয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। বন্ধ হয়ে যায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত। এর সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে। কারণ দেশটির আয়ের সিংহভাগই আসে পর্যটনখাত থেকে। একই সঙ্গে কমে যায় রেমিট্যান্সের প্রবাহ। ফলে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ৭০ শতাংশ কমে যায়।
রাজাপাকসে সরকার ২০২১ সালে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে। তারপর দেশটির চাল উৎপাদন কমে যায়। যদিও পরবর্তী সময়ে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। এসবের পাশাপাশি ছিল বিশাল অংকের বৈদেশিক ঋণের বোঝা।
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশটির বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী নেতারা ঝুঁকি সত্ত্বেও সরকারকে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি দেশটির সরকার। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর তেলের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকায় এপ্রিলে দাতা সংস্থাটির শরণাপন্ন হয় রাজাপাকসে প্রশাসন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৪
আপনার মতামত জানানঃ