ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হায়দ্রাবাদে মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করায় এক হিন্দু যুবককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। ওই যুবকের স্ত্রীর পরিবারের লোকরাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ ‘পরিবারের অমতে’ হিন্দু যুবককে বিয়ে করেছে তাদের মেয়ে।
গত বুধবার (৪ মে) রাতে মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হায়দ্রাবাদে। এদিকে হিন্দু যুবককে প্রকাশ্যেই পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্লাটফর্মে ছড়িয়ে পড়েছে। শুক্রবার (৬ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ছোট বেলা থেকেই একে-অপরকে ভালোবাসতো বি নাগারাজু ও সৈয়দ আশরিন সুলতানা। পরিবারের অমতে গিয়ে তিন মাস আগে তারা বিয়ে করেন। পুলিশ বলছে, ২৫ বছর বয়সী পেশায় গাড়ি বিক্রয়কর্মী বি নাগারাজুকে তার মুসলিম স্ত্রীর ভাই এবং আত্মীয়রা মারধর ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা মেয়ের আত্মীয়। পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে খুন করা হয় হিন্দু যুবককে।
নিহত যুবকের নাম বি নাগারাজু। তিনি একটি গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম আশরিন সুলতানা। ভালোবেসে তিন মাস আগে একে অপরকে বিয়ে করেন তারা। ভিন্ন ধর্মের এই দুই মানুষের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ছোটবেলা থেকেই। দশম শ্রেণি থেকেই তারা একে অপরকে চিনতেন। এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি পরিবার। তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই বিয়ে করেছিলেন নাগারাজু ও সুলতানা।
পুলিশ বলছে, ওই দিন ২৫ বছর বয়সী যুবক নাগারাজুকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তার স্ত্রীর ভাই ও স্বজনেরা।
পুলিশ বলছে, গতকাল রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে ওই দম্পতি মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। পথে দুজন ব্যক্তি তাদের থামিয়ে দেন। মোটরসাইকেল থেকে নাগারাজুকে নামিয়ে লোহার রড ও ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকে।
নিরাপত্তা ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজে দেখা গেছে, দ্রুতই সেখানে মানুষের ভিড় জমে যায়। তবে কেউই হামলাকারীদের থামাতে এগিয়ে আসেননি। অনেককে তাদের মুঠোফোন বের করে এ ঘটনা রেকর্ড করতে দেখা গেছে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, নাগারাজুর স্ত্রী সবার কাছে সাহায্য চাচ্ছিলেন। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন সুলতানা। পরে প্রত্যক্ষদর্শীরা ওই হামলাকারীর দিকে ছুটে যান এবং তাকে মারতে থাকেন। ধাওয়া খেয়ে হামলাকারী পালিয়ে যান। পরে সুলতানা জানান, ওই হামলাকারী তারই ভাই।
রাস্তার পাশেই মারা যান নাগারাজু। সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা মাঝরাস্তায় আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। আমার ভাইসহ পাঁচ ব্যক্তি হামলা চালিয়েছে। আমাদের সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। আমি সবার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। তারা আমার চোখের সামনে তাকে মেরে ফেলল।’
আমাদের বিয়ের আগে ভাই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। দু’ বার আমার গলায় ফাঁস দিয়ে আমাকে ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাঁচার জন্য আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ যদি কোনো সাহায্যই না করতে পারে, তাহলে তাদের আসার কী দরকার ছিল? তারা শুধু তাকিয়ে দেখছিল। তাদের চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটছে, একজনকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তারা কি তা দেখতে পায়নি?’
হামলাকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গেলেও নিরাপত্তা ক্যামেরায় তারা ধরা পড়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা মুঠোফোনে ভিডিওগুলো রেকর্ড করেছেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে বিশেষ দল গঠন করেছে পুলিশ।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগারাজু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সুলতানা গত ৩১ জানুয়ারি আর্য সমাজ রীতিতে বিয়ে করেন। সুলতানা বলেন, বিয়ের আগে একবার নাগারাজু থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে সুলতানা সাংবাদিকদের আরও বলেন ‘আমি তাকে বলেছিলাম, তোমাকে যদি বিয়ে না করতে পারি, তাহলে আর কাউকেই বিয়ে করব না। তাকে বলেছিলাম, জীবন কিংবা মৃত্যু সবকিছু শুধু তোমাকে ঘিরেই।’ বিয়ের পর সুলতানার নাম হয় পল্লবী। তার পরিবার থেকে নাগারাজুকে হুমকি দেওয়া হয়।
নাগারাজুর বোন রমাদেবী এএনআইকে বলেন, ‘মেয়েটির পরিবারের কাছ থেকে হুমকি পাওয়ার পর আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলাম। পুলিশের অবহেলার কারণে আজ ভাইকে হারাতে হলো আমার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল ও।’
মৃত নাগরাজুর স্ত্রী সুলতানা জানিয়েছেন, আমাদের বিয়ের আগে ভাই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। দু’ বার আমার গলায় ফাঁস দিয়ে আমাকে ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাঁচার জন্য আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। হায়দরাবাদে এসে আমরা বিয়ে করি। সিম কার্ডও পালটে ফেলেছিলাম যাতে পরিবারের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে।
পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত অর্থাৎ আশরিনের ভাই ভেবেছিল ভিন ধর্মের যে যুবককে বিয়ে করেছে বোন,তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। নাগরাজুর মৃত্যু কীভাবে হল সেই বিষয়ে আধিকারিকরা জানিয়েছে, বাইক থেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। তারপর লোহার রড দিয়ে এলোপাথাড়ি মারা হয়। শেষে ছুরি জাতীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়, তার ফলেই মৃত্যু হয় তার।
‘অনার কিলিং’ অর্থাৎ ভিন ধর্মে বিয়ে করার ফলে সম্মান রক্ষার্থে খুন, এই ধরনের ঘটনা সাধারণত উত্তর ভারতেই দেখা যেত। দক্ষিণ ভারতে এহেন ঘটনা প্রায় ঘটে না বললেই চলে। পরিস্থিতি দেখে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ উসকে দিয়ে পথে নেমেছে বিজেপি। মৃত যুবক হিন্দু বলে অপরাধের সুবিচার হচ্ছে না, এই দাবিও তুলেছে তারা। তবে পুলিশ ইতিমধ্যেই মূল অভিযুক্ত-সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
এ হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হায়দরাবাদের সারুরনগর এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে স্থানীয় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কর্মীরা বিক্ষোভ করছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৮
আপনার মতামত জানানঃ