ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এলমা চৌধুরী মেঘলার মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার আসামিদের দ্বারা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ প্রভাবিত হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। একইসাথে এলমা চৌধুরীর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মেনে নিতে ডিবির পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
বুধবার(২৭ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এলমার মা দাবি করেন তদন্ত প্রতিবেদন পক্ষপাতমূলক হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে লিখিত বক্তব্যে নিহত মেঘলার মা শারমিন চৌধুরী অভিযোগ করেন, গত ১৯ এপ্রিল মেঘলার স্বামী ও হত্যার অভিযুক্ত আসামি ইফতেখারের জামিন মঞ্জুর হয়েছে। সেদিন পর্যন্ত ঢাকার দায়রা জজ আদালতে ডিবি পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি। আসামি পক্ষ প্রতিবেদন এবং পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের ফটোকপি আদালতে জমা দিয়েছিল মাত্র। বাদী পক্ষের আপত্তির মুখে বিচারক তার বিচার কার্য স্থগিত রেখে উপযাজক হয়ে ডিবির সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে যে- ফটোকপি বা আংশিক প্রতিবেদনগুলো সঠিক কি না। তারপর জামিনের আদেশ দিয়েছে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, অভিযুক্ত আসামির পাসপোর্ট জব্দ করা হয়নি। যেকোনো সময় সে দেশ ছেড়ে চল যেতে পারে। বিবেচনায় আনা হয়নি পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের অসামঞ্জস্যগুলোও। খুনের আসামিকে এভাবে নামে মাত্র নথির ওপর ভিত্তি করে জামিন দেওয়া অবিশ্বাস্য। এর প্রতিবাদ করার ভাষা আমার জানা নেই।
মেঘলার মা শারমিন চৌধুরী জানান, আজ থেকে মাসখানেক আগে আমার স্বামী ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলেন ময়নাতদন্তের খোঁজ নিতে। তখন তাকে বলা হয়, রিপোর্ট আরও একমাস আগে থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা থানায় খোঁজ নিলে তারা জানায়, তাদের কাছে কোনো রিপোর্ট আসেনি, ডিবিতে খোঁজ নেন। ডিবি বলে- কোনো রিপোর্ট আসেনি, থানায় অথবা আবার হাসপাতালে গিয়ে নথি নম্বর নিয়ে আসেন। এভাবে সপ্তাহ ধরে নাটক চলতে থাকে। এক সময় ডিবি থেকে ডাক আসে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট জানানোর নামে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আমাদের মানসিক হয়রানি করা হয়। আমাদের পরোক্ষভাবে চাপ দেওয়া হয়, এটাকে আত্মহত্যা হিসেবে মেনে নিতে।
মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, শরীর, মন, অর্থ, লোকবল চারদিক থেকেই বিধ্বস্ত আমি দেরিতে হলেও সব বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তির কাছে আমি হেরে গেছি। আমি চাই, দ্রুত এর সুষ্ঠু বিচার হোক।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি গত ১৫ এপ্রিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে এলমার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে অপরাধীর অপরাধকে লঘু করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। এলমার মা বলেন, রিপোর্ট এখনও কোর্টে জমা হলো না। ভিকটিম পরিবারকেও জানানো হলো না। আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেয়া হলো না। আইনগতভাবে না-রাজি দেয়ার সুযোগ দেয়া হলো না। তার আগেই টিভি চ্যানেলে উর্ধ্বতন তদন্ত কর্মকর্তারা বিস্তারিত তুলে ধরলেন? এর পেছনে উদ্দেশ্য কী? এসময় তিনি এলমার মৃত্যুর দিনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা এবং বিভিন্ন সময়ে এলমার পাঠানো ভয়েস মেসেজ বাজিয়ে শোনান।
শরীর, মন, অর্থ, লোকবল চারদিক থেকেই বিধ্বস্ত আমি দেরিতে হলেও সব বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তির কাছে আমি হেরে গেছি।
লিখিত বক্তব্যে তিনি দুইটি দাবি তুলে ধরেন। সেগুলো হলো- অনতিবিলম্বে ইফতেখারের জামিন বাতিল করে পুনরায় হেফাজতে নেওয়া এবং সীমান্ত আর ইমিগ্রেশনে রেড এলার্ট জারি করাসহ ইন্টারপোলে ইফতেখারের নামে রেড এলার্ট জারি করা।
এসময় সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, এলমার পরিবারের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন, এলমার ছোটবোন সামান্তা চৌধুরী, সহপাঠী ও ঢাবি বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল হাওয়া আঁখি প্রমুখ।
গত ১৪ ডিসেম্বর বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর বনানীতে স্বামীর বাসায় মারা যান এলমা। তার শরীরে আঘাতের অনেক চিহ্ন দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন সহপাঠীরা। তবে এলমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির মানুষের দাবি তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় এলমার স্বামী ইফতেখার আবেদীন, শ্বশুর অবসর প্রাপ্ত লে. কর্নেল মো. আমিন ও শাশুড়ি শিরিন আমিনকে আসামি করা হয়।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন, নৃত্যকলা বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী এলমা চৌধুরীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা এ মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এলমার পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। তাকে মানসিকভাবেও নির্যাতন করা হয়েছে। এটি খুবই মর্মান্তিক। এটি স্পষ্ট একটি হত্যা। আমরা এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্ত দাবি করছি।
তারা বলেন, ‘এলমার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি শুধু মর্মান্তিক নয়, নৃশংসও বটে। আমরা এর দ্রুত বিচার দাবি করছি। আমাদের দেশে বিচারপ্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ হয়। এলমার স্বামী প্রভাবশালী বলে আমরা জেনেছি। অনেক সময় প্রভাবশালী হওয়ার কারণে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হয় না। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে প্রত্যাশা রাখি।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৬
আপনার মতামত জানানঃ