মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে মানব জাতি ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে টিকে থাকার তাগিদে। প্রথমে শিকার করে তারপর দলবদ্ধ হয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে জীবন যাপন করতো মানুষজন। কিন্তু ১২,০০০ বছর আগে অভাবনীয় উন্নতি ঘটে মানব সভ্যতায়। অনেক অল্প সময়ের ব্যবধানে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় মানব সভ্যতার ইতিহাসে।
প্রস্তর যুগ থেকে একদম চাঁদে পদার্পণ করার মাঝখানের সময়টা অতীত ইতিহাসের তুলনায় অনেক কম সময়ের মধ্যেই হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, কি এমন হয়েছিল যে মানব সভ্যতার উন্নয়ন একদম এতো লম্বা একটি লাফ দিতে সক্ষম হয়েছিল।
গবেষকরা এই নাটকীয় পরিবর্তনের পিছনের কারণ অনুসন্ধান করে চলেছেন অনেক বছর যাবত। তুরস্কের গোবেকলি টেপিতে গিয়ে হয়তো জানা সম্ভব কিভাবে আমরা প্রস্তর যুগ থেকে এতো অল্প সময়ের মধ্যে অত্যাধুনিক যুগে পদার্পণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম এবং কোন কোন বিষয়গুলো আমাদেরকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছিল সে ক্ষেত্রে।
চাঁদে পা রাখাটাকে মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে মনে করেন অনেকেই কিন্তু আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন হল কৃষিকাজের আবিষ্কার ও নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করার ক্ষমতা অর্জন।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মানুষ এমনটাই ভাবতো যে কৃষিকাজের বদৌলতেই মানুষজন প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে এবং একসাথে বসবাস শুরু করার মাধ্যমেই জন্ম নেয় ধর্মের, সামাজিক বন্ধনের। যার ফলে বসবাস করার জন্য ঘরবাড়ি আর ধর্মচর্চার জন্য উপাসনালয় গড়ে তুলে মানুষ। আর এই সকল স্থাপনা নিয়ে গড়ে উঠতে থাকে শহর ও নগরী। এবং এর মাধ্যমেই যাত্রা শুরু হয় নতুন সভ্যতার।
সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের অতীত যাযাবর জীবনের অনিশ্চয়তা যেমন প্রতিবেলার খাবার নিয়ে চিন্তা করা বা শিকারের চিন্তা কমতে থাকলো। তখন মানুষ তাদের সময় গুলো বিনিয়োগ করা শুরু করলো চিন্তা ভাবনায়। তারা জীবন নিয়ে ভাবতে শিখলো, কিভাবে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করে নিজেদেরকে উন্নত করা যায় সে কথা ভাবতে লাগলো। কিন্তু ‘গোবেকলি টেপি’ মানব ইতিহাসের এমন একটি নিদর্শন যা আমাদের এতদিনের পুরানো ধারণা বা বিশ্বাসকে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছে।
গোবেকলি টেপি হল একটি নিদর্শনের নাম যেখানে ৫,০০০ বছর আগে প্রথম মানব বসতি গড়ে উঠেছিল এবং এটিই ছিল প্রথম মানব সভ্যতা। তুরস্কের ভাষায় গোবেকলি টেপির মানে হল নাদপেটে লোকের মত দেখতে পাহাড়। এখানকার লোকেরা এই পাহাড়কে পবিত্র মনে করে থাকে।
প্রফেসর ক্লাউস স্মিট (Dr. Klaus Schmidt), একজন বিখ্যাত জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ, ১৯৯৬ সালে এই পাহাড় এর নিচে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বিষয় আবিষ্কার করেন এবং তখন থেকে তার মৃত্যুর (২০১৪ সাল) আগ পর্যন্ত তিনি এবং তার একটি দল এই স্থান খনন করেছেন। তিনি সেখানে পাথরের অনেকগুলো পিলার খুঁজে পান যাতে অদ্ভুত সব খোদাই করা ছিল। তিনি বুঝতে পারেন যে অনেক বড় কোন রহস্য লুকিয়ে আছে এই পাহাড়ের নীচে, তাই তিনি বেড়িয়ে পড়েন আশেপাশের এলাকা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে।
তিনি ঐ পাহাড়ের আশেপাশে প্রায় ৯০,০০০ বর্গমিটার জায়গা যা প্রায় ২০ টি ফুটবল খেলার মাঠের সমান বড় সেখানে সমীক্ষা চালান। সমীক্ষা থেকে তিনি অনুমান করেন ঐতিহাসিক ঐ স্থানের আয়তন কমপক্ষে ৩০০ বাই ৩০০ মিটার। অনেক ধৈর্য ও যত্ন সহকারে তিনি ও তার সহযোগীরা মিলে ৪ টি পাথরের তৈরি বিশালাকার বৃত্তাকার জায়গা খুঁজে বের করেন। এই বৃত্তাকার জায়গা গুলো উঁচু উঁচু পাথরের পিলার দিয়ে ঘেরা ছিল এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর ‘টি’ আকৃতির মাথাযুক্ত পিলার ছিল। ‘টি’ আকৃতির মাথাযুক্ত এই একপ্রস্তর বিশিষ্ট পিলার গুলোর উচ্চতা গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ মিটার পর্যন্ত। এবং এই পিলার গুলোর আকৃতির সাথে বর্তমান সময়ের কোন জিনিস বা স্থাপনার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
টি আকৃতির পিলারের মাথায় বিভিন্ন প্রাণী ও জন্তুর প্রতিকৃতি খোদাই করা ছিল। স্মিট মনে করেন এই প্রাণী গুলো দিয়ে মানুষকে নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ টি আকৃতির পিলারের মাথার অংশটি দিয়ে মানুষের মাথা এবং বাকি অংশটি দিয়ে মানুষের শরীর বুঝানো হয়েছে। এবং এই মানুষগুলো সম্ভবত অভিভাবক শ্রেণীর মানুষ ছিলেন বলে তিনি মনে করেন।
কিন্তু এই মাথার মত অংশে কোন নাক, মুখ বা চোখের আলাদা উপস্থিতি নির্ধারণ করা যায়নি। তাই ধারণা করা হয় যে এই পিলারগুলো হয়তো মানুষ না বরং মানুষের মত কাছাকাছি দেখতে অন্য কোন প্রাণী বা দেব দেবীর প্রতিকৃতি। তাই আবার অনেকে এই স্থানটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন উপাসনালয় বলেও মনে করে থাকেন।
গোবেকলি টেপি প্রায় ১২,০০০ বছর পুরানো। এতো পুরানো হওয়া স্বত্বেও এর সৌন্দর্য স্টোনহেঞ্জের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তব ধর্মী। এটি মিশরের পিরামিডের চেয়েও ৭,০০০ বছর পুরানো। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক গুলো স্থাপনা এই পাহাড়ের নীচেই পড়ে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এখানে অবাক করার মত বিষয় হল ১২,০০০ বছর আগে যখন এই স্থাপনা গুলো নির্মাণ করা হয়েছিল তখন মানুষ প্রস্তর যুগে বসবাস করতো, তখন তারা আগুন কিভাবে জ্বালাতে হয় তা তো জানতো কিন্তু তখনও চাকা আবিষ্কার হয়নি কিংবা গৃহপালিত পশুপালনের মাধ্যমে যে প্রাণীদের সাহায্য নিবে সেটাও আবিষ্কার হয়নি।
তাহলে তারা এতো বড় বড় পাথর খণ্ড ব্যবহার করে কিভাবে এতো বড় বড় স্থাপনা গড়ে তুলল? আর তাছাড়া এতো বড় একটা কাজ করার জন্য অনেক বেশি নিয়মানুবর্তী ও সংঘবদ্ধ হতে হয় যা ঐরকম যাযাবর সমাজের কাছে আশা করাটা একটু কষ্টকর। আর তাছাড়া এতো বড় একটা কাজ সম্পন্ন করার জন্য অনেক গুলো মানুষের একত্রে অনেক দিন থাকতে হয়েছে, তাদের থাকার জন্য নিশ্চয় বাড়ি ও খাদ্যের দরকারও পড়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশাল সংখ্যক মানুষগুলো কারা, যারা মাটির পাত্র কিভাবে তৈরি করতে হয় সেটা আবিষ্কার হওয়ার আগেই পাথরের এতো বড় একটি স্থাপনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল? আর কিই বা উদ্দেশ্য ছিল তাদের এই স্থাপনা গড়ে তুলার পিছনে?
গোবেকলি টেপি খনন করার সময় সেখানে অনেক গুলো প্রাণীর হাড় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। হাড়গুলো পরীক্ষা করে জানা যায় সেখানে কোন গৃহপালিত বা তৃণভোজী প্রাণীর হাড় ছিল না। প্রাপ্ত হাড় গুলো সবই বিভিন্ন বন্য প্রাণী যেমন: বন্য শুকর, লাল হরিণ, বন্য ভেড়া ইত্যাদির। এর থেকে বুঝা যায় যে যখন গোবেকলি টেপি তৈরি হচ্ছিলো তখনও মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে শিকার করতো, কৃষিকাজ তখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
কিন্তু মিশরের পিরামিডের ইতিহাস অনুযায়ী মানুষজন গোবেকলি টেপি বা পিরামিডের মত স্থাপনা কেবল তখনই তৈরি করতে পেরেছে যখন তারা কৃষিকাজ আবিষ্কার করেছে, এক জায়গায় অনেক জন একত্রে বসবাস করা শুরু করেছে এবং যারা স্থাপনা গুলো বানাবে তাদের জন্য খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। কিন্তু গোবেকলি টেপিতে পাওয়া তথ্য কিন্তু অন্য কথা বলছে।
স্মিট মনে করেন ১২,০০০ বছর আগে মানুষ আধা যাযাবর অবস্থায়ই গোবেকলি টেপির কাজ শুরু করেন কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে ছোট ছোট দলের উন্নতি না করে অনেকে একসাথে থেকে কাজ করলে এবং নিজের জ্ঞানকে সংরক্ষণ করতে ও ছড়িয়ে দিতে পারলে বৃহত্তর লাভ হবে।
গোবেকলি টেপি একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত যার আশেপাশে পানির কোন উৎস নেই। মানুষজনকে তখন খাবার ও পানি পাহাড়ে বহন করে নিয়ে যেতে হতো তাই একটানা অনেকদিন ঐখানে থাকা সম্ভব ছিল না। তাহলে তারা নিশ্চয় আশেপাশের সবচেয়ে কাছের কোন জায়গায় বসবাস করতো।
গোবেকলি টেপির সবচেয়ে কাছে যে শহরটি সেটার নাম শানলুফা, এটি গোবেকলি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই শহরের ইতিহাস বেশ চিত্তাকর্ষক। বর্তমানের ৩ টি বড় একেশ্বরবাদী ধর্মের জনক আব্রাহাম এখানে জন্মগ্রহণ করেন ৪,০০০ বছর আগে। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এই শহর এর চেয়েও বেশি পুরাতন।
তুরস্কের বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ চেলাক এই শহরের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। তার ভাষ্যমতে, এই শহরের মাটির নীচে পাথরের তৈরি অনেক যন্ত্রপাতি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যেগুলো প্রায় ১১,০০০ বছর আগে প্রস্তরযুগের তৈরি বলে তিনি মনে করেন। এছাড়াও শানলুফার একটি যাদুঘরে একটি মূর্তি রয়েছে যা এই শহরের নির্মাণ কাজ চলাকালে মাটির নীচে পাওয়া গিয়েছিল যেটার বয়স আনুমানিক ১১,০০০ বছর। এর থেকে স্পষ্টতই ধারণা করা যাচ্ছে যে, গোবেকলি টেপি নির্মাণ কারী লোকজন শানলুফা বা এর আশেপাশেই কোথাও বসতি স্থাপন করেছিল।
গোবেকলি টেপি কে বা কারা তৈরি করেছিল, কেন তৈরি করেছিল সেটা নিকট ভবিষ্যতে জানার সম্ভাবনা খুবই কম কেননা একে ঘিরে অনেক বেশি রহস্য রয়ে গেছে অজানা। যেমন ধরা যাক ১২,০০০ বছর আগে তৈরি হওয়া এই অসাধারণ স্থাপনা কেন ৯,০০০ বছর আগে পরিত্যক্ত হয়েছিল সে ব্যাপারে বলতে পারেনি কেউ এখন পর্যন্ত। এতো কষ্ট করে তৈরি করা এই স্থাপনাটি মানব সভ্যতার সূচনা করেছিল কিন্তু এর পরিণতি এমন কেন হয়েছিল সে প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি আজো।
গোবেকলি টেপির বিশাল বিশাল প্রস্তর খণ্ডের নীচে চাপা পড়ে আছে তার চেয়েও বিশাল অনেক রহস্য। কিন্তু এই বিশাল স্থাপনার মাত্র ৫% খনন করা হয়েছে। প্রফেসর স্মিট মনে করেন যে পরবর্তী প্রজন্ম যেন এসে এই অসমাপ্ত রহস্য উদ্ধার করে। আর তাছাড়া ভবিষ্যতে আরও অনেক উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার হবে যা দিয়ে সহজে হয়তো আরও অনেক কিছু জানা যাবে বলে তিনি মনে করেন।
গোবেকলি টেপি আবিষ্কার হওয়ার পর প্রত্নতাত্ত্বিক গণ এর নিদর্শন গুলোকে অনেকটা একদম নতুন অবস্থায় পেয়েছেন। কারণ হল গোবেকলি টেপি নির্মাণকারীরা ৯,০০০ বছর আগে এই স্থান ত্যাগ করার আগে এই উপাসনালয়ের বেশ কিছু অংশ মাটি চাপা দিয়ে গিয়েছিল হয়তো শত সহস্র বছর পরও যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ