জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে আরও উত্তাল হবে ভারতের উপকূল এলাকা। বাড়বে সমুদ্রের পানিস্তর।একের পর এক মারণ ঝড় আছড়ে পড়বে বঙ্গোপসাগর উপকূলে। মূলত বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণ চীন সাগর ও দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় উপকূল এলাকায় এমন প্রবণতা লক্ষ করা যাবে।এমনটি জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা।
সম্প্রতি ‘ক্লাইমেট ডায়নামিক্স স্প্রিংগার’ নামে একটি জার্নালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন আইআইটি খড়গপুরের গবেষকরা। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝোড়ো হাওয়ার কারণে সমুদ্রে বড় ঢেউয়ের প্রবণতা বাড়তে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূল এলাকা। সমুদ্রের নোনা জল স্থলভাগে ঢুকে মিশবে ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে। নষ্ট হবে প্রচুর ফসল। অর্থাৎ, এর প্রভাব সরাসরি পড়বে আর্থসামাজিক ভিত্তির ওপর।
গবেষকেরা জানান, মূলত জুন-জুলাই-আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঝোড়ো হাওয়া এবং বড় ঢেউয়ের প্রবণতা বাড়বে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় উপকূলে। দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়তে পারে অন্তত এক মিটার।
অন্যদিকে, গত শতাব্দীর প্রবণতা থেকে গবেষকদের দাবি, ঝড়ের দাপট বাড়বে মধ্য বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এলাকায়। উত্তর ভারত মহাসাগর, উত্তর-পশ্চিম আরব সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ঢেউয়ের উচ্চতা প্রায় ০.৪ মিটার বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
ঝোড়ো হাওয়ার কারণে সমুদ্রে বড় ঢেউয়ের প্রবণতা বাড়তে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূল এলাকা। সমুদ্রের নোনা জল স্থলভাগে ঢুকে মিশবে ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে। নষ্ট হবে প্রচুর ফসল। অর্থাৎ, এর প্রভাব সরাসরি পড়বে আর্থসামাজিক ভিত্তির ওপর।
দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে গোটা বিশ্ব।
জলবায়ু যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে আগামী দিনে আরও ভয়ঙ্কর ঝড় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মার্কিন ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির পরিচালক ডিন ক্রিসওয়েল।
সারা বিশ্বের আবহাওয়াবিদরা বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে সারা বিশ্বের আবহাওয়া আরও চরম আকার ধারণ করবে। কিন্তু এই চেহারা যে কতটা ভয়ঙ্কর তার উদাহরণ পাওয়া গেল যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকিতে।
সম্প্রতি প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে ৪০০ কিমি বেগে টর্নেডো বয়ে গিয়েছে আরকানসাস থেকে কেন্টাকি অবধি। মিসৌরি ও ইলিওনিসও রক্ষা পায়নি।
ঝড়ের সতর্কতা থাকলেও, তা এতটা ভয়ঙ্কর আকার নেবে, তা কল্পনা করা যায়নি। এখন পর্যন্ত ঝড়ের তাণ্ডবে শতাধিক মানুষ মারা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ছয়টি রাজ্যে বিশাল টর্নেডো হওয়ার পর মার্কিন জরুরি ব্যবস্থাপনার শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এটাই হবে আমাদের নিউ নর্মাল(নতুন স্বাভাবিক)। তিনি মনে করিয়ে দেন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আগামীতে কতটা সমস্যা করতে পারে। তিনি বলেন ‘আমরা আরও ভয়ঙ্কর ঝড়ের সাক্ষী হব, সে হারিকেনই হোক বা টর্নেডো, হতে পারে ভয়ঙ্কর দাবানলও। কী ভাবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলতে পারে, সেই পথ ভাবতে হবে আমাদের।’
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বৈজ্ঞানিক সমিতি এজিইউ জানিয়েছে, ‘বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গুরুতর আবহাওয়ার অনুকূল পরিস্থিতির ঘটনাকে প্রভাবিত করবে’।
ইউসিএলএ জলবায়ু বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল সোয়েন টুইট করে বলেছেন যে, উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী অনেক অঞ্চলে টর্নেডোর মতো আরও ভয়ঙ্কর ঝড় হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন তুঙ্গে। এখন পর্যন্ত রেকর্ড বইয়ের তথ্যে গত বছরের জুলাই মাসটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। এমনটাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান এবং জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল ওশনিক অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব উত্তপ্তকারী বিপজ্জনক গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে সামুদ্রিক পানির উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব এটিকে ‘মানবতার জন্য লাল সংকেত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি এখনই সব শক্তি একত্রিত করি, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। প্রতিবেদন এটি পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, দেরি করার মতো সময় নেই আর কোনো অজুহাতেরও জায়গা নেই।
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগে ১০০ বছরে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা ঘটবে। এই শতাব্দীজুড়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু সংকটের সরাসরি প্রভাবে মনুষ্য বসতির কাছাকাছি এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের উদ্ভব হচ্ছে। মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। আলাদাভাবে প্রতিটি দেশ এমন একটা পথ বের করার ওপর জোর দেবে, যাতে করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারে।
তারা বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে সজাগ হওয়ার। নইলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সীমারেখা মানছে না, সে হোক উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ