চলতি বছরের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় তালিবান। এরপর তারা নতুন সরকার গঠন করলেও এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশটি। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছে না কন্যাশিশুরাও। ফলে আফগানিস্তানে ক্রমশ বাড়ছে ‘শিশুবধূ’র সংখ্যা।
খাদ্য সংকট কতটা চরমে পৌঁছালে একজন বাবা তার কন্যাসন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন বাবার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ায় আফগানিস্তানের অনেক নাগরিককেই এখন এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কুঁড়েঘরের বিস্তীর্ণ বসতিতে বাস্তুচ্যুত মানুষদের বসবাস। সেখানকার একজন নারী তার ১০ বছরের মেয়ে কান্দি গুল’কে সম্পূর্ণভাবে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। খবর দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড।
আজিজ গুল নামের ওই নারীর স্বামী ১০ বছরের মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছেন। জানা গেছে, পরিবারের সদস্যদের মুখে আহার তুলে দেওয়ার জন্য নিরুপায় ওই বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কিছু অর্থ পেয়েছেন।
আজিজ গুলের স্বামী হামিদ আবদুল্লাহর মতো আফগানিস্তানের অনেকেই অভাবের কারণে এ ধরনের হৃদয় বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যদের বিশৃঙ্খল প্রত্যাহারের মধ্যে গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তালেবান যখন ক্ষমতা দখল করে, তখনই সাহায্য-নির্ভর দেশটির অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।
এদিকে ২০ বছর আগে তালিবানের শাসনামলে বর্বরতার অভিজ্ঞতা থেকে এবার তালিবান সরকারের সাথে কাজ করতে অনিচ্ছুক আন্তর্জাতিক মহল। সে কারণে আফগানিস্তানে বিদেশি সাহায্যও স্থগিত রয়েছে।
যদিও খুবই অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা পুরো অঞ্চল জুড়ে একটি নিয়মিত অভ্যাস। সেখানে বরের পরিবার প্রায়শই দূরের আত্মীয়রা হয়ে থাকে। বিয়ের ব্যাপারে চুক্তি করার জন্য অর্থ প্রদান করে তারা। কন্যাশিশুটি সাধারণত তার বাবা-মায়ের সাথে থাকে তার বয়স কমপক্ষে ১৫ বা ১৬ বছর না হওয়া পর্যন্ত।
এমনকি মেয়ের বয়স ১৫ কিংবা ১৬ বছর হওয়া পর্যন্ত অনেক পরিবার অপেক্ষা করতে পারে না। কারণ, এতোদিন পর্যন্ত মেয়েকে বাড়িতে রেখে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য তাদের নেই।
এ ধরনের পরিবার ছোট্ট বরের পরিবারকে বলে, আপনারা আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন। এমনকি এ ধরনের পরিবার নিরুপায় হয়ে তাদের ছোট ছেলেদেরও বিক্রি করার চেষ্টা করছে।
পরিবারের সদস্যদের মুখে আহার তুলে দেওয়ার জন্য নিরুপায় ওই বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কিছু অর্থ পেয়েছেন।
পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে মেয়েকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন গুল। তিনি বলেছেন, ১৫ বছরের আগে আমার মেয়েকে কেউ নিয়ে গেলে আত্মহত্যা করবো।
গুল আরো বলেন, দুই মাস আগে আমার মেয়েকে আমার স্বামী বিক্রি করেছে। ওই ঘটনার পর পরিবারের সদস্যরা খেতে পারছে। তবে মেয়েকে কোনোভাবেই এতো অল্প বয়সে হারাতে চান না তিনি।
গুল বলেন, স্বামীর কাছে জিজ্ঞেস করেছি- খাবার কেনার টাকা সে কোথায় পেল। পরে জানতে পারি, সে আমার মেয়েকে বিক্রি করেছে বিয়ে দেওয়ার জন্য।
তিনি আরো বলেন, কথাটি শুনে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার বারবার মনে হচ্ছিল, ওই সময় মরে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু আল্লাহ হয়তো এখনই আমার মৃত্যু দিতে চায় না।
তিনি আরো বলেন, স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছি, কেন সে এমন করল। সে শুধু বলেছে, একজনকে হারিয়ে বাকিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। আমি বলেছি, তুমি যা করেছ, তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিল। আমি এই খাবার খেয়ে বাঁচতে চাই না।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তান। গত বছরের আগস্ট মাসে তালিবানরা দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দেশটিকে সহায়তা করে আসছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে আগস্টে তালিবান ক্ষমতাচ্যুত করার পর ওই সব সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলেই সমূহ বিপদে পড়েছে দেশটি।
এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন যেসব আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি টিকে ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে এবং তালিবান সরকারের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
তালিবান নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের সিদ্ধান্তহীনতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। তালিবানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তহীনতার ফল ভুগতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আফগানিস্তানে দিনের পর দিন কন্যা শিশুসন্তান বিক্রির ঘটনা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, খাদ্য ও কাজের অভাব এবং বিভিন্ন সংকটে থাকা পরিবারগুলো এমন সিদ্ধান্তকেই সঠিক বলে মনে করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে আফগানিস্তানের এসব বিপন্ন মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শিগগিরই পৌঁছতে হবে। তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে কী হবে না, এ বিতর্কে আটকে গেলে এখানকার লাখ লাখ শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ