জাপানের ভয়ংকর একটি প্রথার নাম ‘হিটোবাশিরা’ বা ‘দা সেং ঝুয়াং’। এই প্রথায় ১৬ শতক পর্যন্ত জাপানের কিছু স্থানে দুর্গ, সেতুর মতো বড় নির্মাণযজ্ঞের শুরুতে মানব বলিদান করা হতো। ভয়ংকর এই রীতি পালনের জন্য ভিকটিমদের ভিত ও স্তম্ভের ভিতরে জীবন্ত সমাহিত করা হতো।
সে সময় জাপানিদের বিশ্বাস ছিল যে, বড় আকারের দুর্গ, সেতু নির্মাণের সময় পৃথিবীর নড়াচড়ায় ভূমির ‘ফেংশুই’কে বিরক্ত করে, এর ফলে নির্মাণের সময় এবং পরে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই এই ধরনের মানব বলিদান দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য প্রয়োজন ছিল যাতে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা শত্রুর আক্রমণে ভবন বা সেতু ধ্বংস না হয়।
‘হিটোবাশিরা’র প্রথম লিখিত রেকর্ডগুলো ‘নিহন শোকি’ (জাপানের ক্রনিকলস) এ পাওয়া যায়। ‘নিহন শোকি’র তথ্য অনুযায়ী, ‘হিটোবাশিরা’ আনুমানিক ৩০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল।
সেসময় সেখানে ‘কিতাকাওয়া’ ও ‘মামুতা’ নামে দুটি নদী ছিল। নদী দুটির কারণে আশপাশের অঞ্চলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হতো। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতো। এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতো। সেসময় সম্রাট নিন্টোকু এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তিনি একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন।
প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, সম্রাট স্বপ্নে একটি ঐশ্বরিক আদেশ পেয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল যে, কোওয়াকুবি নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি মুসাশি প্রদেশে বাস করতেন এবং কোরোমোনো-কো নামে আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি কাওয়াচি প্রদেশে বসবাস করতেন।
সম্রাট নিন্টোকুকে বলা হয়েছিল যদি এই দুই ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় এবং ‘কিতাকাওয়া’ ও ‘মামুতা’ নদী দুটির প্রতিটিতে একেকজনকে দেবতার জন্য বলি দেওয়া যায়, তাহলে বন্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ হয়ে যাবে।
এরপরই কোওয়াকুবি ও কোরোমোনো-কো নামক দুজন ব্যক্তিকে খোঁজা শুরু হয়। তাদের উভয়কেই পাওয়া যায় এবং খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দি করা হয়। কাওয়াকুবি ছিলেন দরিদ্র। তিনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন সহজ-সরল প্রকৃতির। তাকে কিতাকাওয়া নদীর স্রোতে নিক্ষেপ করে নদীর দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছিল।
কিন্তু কোরোমোনো-কো ছিলেন চালাক প্রকৃতির মানুষ। বলিদানের দিন কোরোমোনো-কো তার সাথে দুটি লাউ এনেছিলেন। এরপর নদীর দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি এখানে এসেছি আপনার কাছে আমার জীবন উৎসর্গ করতে। কারণ আপনি এই অঞ্চলের মানুষের উপর দুর্যোগ ডেকে আনছেন। যদি আপনি আন্তরিকভাবে আমার জীবন চান, তাহলে এই লাউগুলোকে ডুবিয়ে দেন যাতে এগুলো আর ভাসতে না পারে; তাহলে আমি আপনাকে এই নদীর প্রকৃত দেবতা বলে জানব এবং আপনার কাছে আমার দেহ নিবেদন করব। কিন্তু আপনি যদি এগুলো ডুবাতে না পারেন, তাহলে আমি মনে করব আপনি প্রকৃত দেবতা নন এবং আমার জীবনকে নিবেদন করা বৃথা হবে।’
এই কথা গুলো বলার পর কোরোমোনো-কো নদীতে লাউ দুটি নিক্ষেপ করেন। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো নদীর পানিতে ডুবে যায়নি এবং কোরোমোনো-কোও বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পান।
‘হিতোবাশিরা’র প্রথা সবসময়ই রহস্যময়, ভয়ংকর এবং প্রায়ই পানি-সম্পর্কিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। যেমন সেতু নির্মাণের সঙ্গেও এ প্রথা চর্চার ইতিহাস আছে। ১৫ শতকের ইয়াসুতোমি-কি নামক একটি ডায়েরি থেকে জানা যায়, নাগারা নদীতে একটি বড় সেতু তৈরি করার সময় মানব বলিদান করা হয়েছিল।
কিংবদন্তি অনুসারে, মহান সেনাপতি হোরিও ইয়োশিহারু যখন প্রথম এই নদীর মুখে একটি সেতু স্থাপনের উদ্যোগ নেন, তখন নির্মাতারা বৃথা পরিশ্রম করেছিলেন। কারণ সেতুর স্তম্ভগুলোর জন্য নীচে কোনো শক্ত ভিত ছিল না। লক্ষ লক্ষ পাথর বিনা কারণে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল দিনে নির্মিত অংশ রাতে ভেসে যেতো। অনেক কষ্টে করে সেতু নির্মাণ করা হলেও কাজ পুরো শেষ হতে না হতেই পিলারগুলো ডুবে যেতে থাকে। এরপর ভয়াবহ এক বন্যায় সেতুটির অর্ধেক ভেসে যায়।
জানা যায়, যতবার সেতুটি মেরামত করা হয়েছে ততবারই এটি ভেঙে পড়েছে। তারপর বন্যা থেকে মুক্তি পেতে নদীতে একটি মানব বলি দেওয়া হয়েছিল। মাঝখানের স্তম্ভের নীচে নদীর তলদেশে এক ব্যক্তিকে জীবন্ত সমাহিত করা হয়েছিল। এরপর সেতুটি তিনশ বছর ধরে টিকে ছিল।
প্রচলিত এই কিংবদন্তিটি এত গভীরভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ১৯ শতকের শেষের দিকে যখন সেখানে নতুন একটি সেতু তৈরি করা হচ্ছিল তখন ঐ অঞ্চলের হাজারো লোক শহরে আসতে ভয় পেতো। কারণ তখন গুজব উঠেছিল যে, একজনকে বলি দেওয়ার প্রয়োজন হবে নতুন সেতু নির্মাণের পূর্বে।
মানব বলিদানের এ প্রথা বড় দুর্গ নির্মাণের সাথেও জড়িত ছিল। মারুওকা দুর্গ হলো জাপানের টিকে থাকা প্রাচীনতম দুর্গগুলোর মধ্যে একটি, যা ‘হিটোবাশিরা’ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে কল্পকাহিনি প্রচলিত রয়েছে। মারুওকাতে এ দুর্গটি তৈরি করার সময় অসংখ্যবার দেয়াল স্থাপন করা হলেও প্রতিবার দুর্গের পাথরের দেয়াল ভেঙে পড়তে থাকে।
সেসময় একজন উচ্চবর্গের লোক তাদের কাউকে ‘হিটোবাশিরা’ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ও-শিজু নামের একজন একচোখা মহিলা ছিলেন। তার দুটি সন্তান ছিল। তিনি দরিদ্র মানুষ ছিলেন। তাকে ‘হিটোবাশিরা’ দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। ও-শিজু মৃত্যুর পূর্বে দাবি করেছিলেন যে, তার একটি সন্তানকে ‘হিটোবাশিরা’ দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে সামুরাই বানানো হবে। ও-শিজুকে ক্যাসল কিপের কেন্দ্রীয় স্তম্ভের নীচে সমাহিত করা হয়েছিল। এরপরে দুর্গের নির্মাণ কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
‘হিতোবাশিরা’র এই রহস্যময় রীতি আরো কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল। তবে সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪২
আপনার মতামত জানানঃ