সৌরজগতের সৃষ্টির সময়েই তৈরি হয়েছে অসংখ্য গ্রহাণু। পৃথিবীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম গ্রহাণুর সংখ্যা কতো সেটা সুনির্দিষ্ট করে জানা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণুর সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে। এসব গ্রহাণুর বেশিরভাগই আকারে ছোট।
নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ বলেন, মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে কয়েক কোটি গ্রহাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। তাই কোনো গ্রহের সঙ্গে কোনো একটি গ্রহাণুর সংঘর্ষ অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। আর এতে ধ্বংস হতে পারে গ্রহটি। সেটা আগেও ঘটেছে।
৪৫০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী, মঙ্গল এসব গ্রহের সৃষ্টি হয় তখন গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই গ্রহগুলো আকারে বড় হয়েছে। আজকে যে পৃথিবী গ্রহটি এত বড় হয়েছে এর কারণ বিভিন্ন গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ।
গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষের পরিণতি কী হতে পারে?
কোনো একটি গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত করলে বা সেটি যদি গিয়ে কোনো একটি দেশের কোনো একটি শহরে গিয়ে পড়ে, তাহলে কী হবে? শুধু কি ওই শহরটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে? নাকি গোটা পৃথিবী? আর এর সম্ভাবনাই বা কতোটা?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্ষতি নির্ভর করবে গ্রহাণুটি আকারে কতটা বড়ো তার উপর। যেমন সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষের কারণে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন গ্রহাণুটি এত জোরে পড়েছিল যে এর ফলে বায়ুমণ্ডলে অনেক ধুলো ছড়িয়ে পড়ে। একারণে কয়েক বছর বা কয়েক মাসের জন্য সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারেনি। আর আমরা সবাই জানি প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য সূর্যের আলো খুবই জরুরি।
তাই গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেটি হবে পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। কোনো একটি শহরে গ্রহাণু এসে পড়লে ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ওই শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পুরো গ্রহেই তার প্রভাব পড়বে। আর এটি ঘটাও খুব স্বাভাবিক। আগেও ঘটেছে। সামনে ঘটার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
সংঘর্ষের ফলে যদি কোথাও বড় ধরনের আগুন লেগে যায় বা একটা বিশাল গর্ত তৈরি হয় এবং যদি এর সব ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে চলে যায়, তাহলে সারা গ্রহেই ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরকম হলে পৃথিবীর প্রাণীরা হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে না। এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না। নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় লক্ষ্য করেছে।
সংঘর্ষের সম্ভাবনা কতটা?
ধারণা করা হয় যে পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল মঙ্গলের মতো একটি বস্তুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলেই। পৃথিবী ভেঙে তার টুকরো দিয়েই চাঁদের জন্ম হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সঙ্গে এসব গ্রহাণুর সংঘর্ষের সম্ভাবনা কতোখানি সেটা বলা খুব কঠিন। তবে এধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে।
গত শতাব্দীর শুরুর দিকে রাশিয়াতে একটি গ্রহাণু পড়েছিল যা পারমাণবিক বোমার মতো আঘাত হেনেছিল, যার ফলে একটি বন ধ্বংস হয়ে যায়। আর এটা তো সবারই জানা যে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বড় আকারের একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল। এর ফলে সারা পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই প্রাণীটি কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে মহা-দাপটের সঙ্গে বিচরণ করতো।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলছেন, পৃথিবীর সঙ্গে গ্রহাণুর আবার এধরনের সংঘর্ষের সম্ভাবনা কতো তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কিন্তু এরকম জিনিস ঘটে এবং ঘটছে। আগামী ১০ বছরে, কী ১০০ বছরে, কী ১০০০ বছরে এরকম আরো একটি ঘটনা ঘটবে কি না, ঘটলে কখন ঘটবে; সেসব বলা খুবই জটিল।
কতটা প্রস্তুত পৃথিবী?
সম্প্রতি নাসা যে গ্রহাণুটিকে লক্ষ্য করে যান পাঠিয়েছে তার নাম ডাইমরফোস। এটি আকারে ১৬০ মিটার চওড়া। কিন্তু যে মহাকাশ যান দিয়ে এটিকে ধাক্কা দেওয়া হবে সেটি আকারে এই গ্রহাণুর তুলনায় খুবই ছোট। এটা গ্রহাণুটির গতিপথ পাল্টাতে পারবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত না বিজ্ঞানীরা।
নাসার বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ বলছেন, ভেবে দেখুন খুব বড় একটি ট্রেন আসছে। একটি গাড়ি দিয়ে খুব জোরে ট্রেনটিকে ধাক্কা দেওয়া হলো। ট্রেনটির তখন লাইন থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীরাও এরকম একটি ধারণা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন যে ছোট একটি যান দিয়ে খুব জোরে ধাক্কা দিলে গ্রহাণুর গতিপথ কতোটা বদলে যেতে পারে?
তাদের মতে, এখানে তিনটি জিনিস বিবেচনা করতে হবে: হয় অনেক জোরে আঘাত হানতে হবে, অন্যথায় যেটি দিয়ে আঘাত করা হবে সেটি অনেক বড় হতে হবে, অথবা দুটোই। তবে এভাবে গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব কি না তা নিশ্চিত নয় এখনও।
নাসা বলছে, ডাইমরফোস গ্রহাণুটির আরেকটি বড় গ্রহাণুকে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ১১ ঘণ্টার মতো। তারা আশা করছেন সেখানে ৬০/৭৫ সেকেণ্ডের মত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হতে পারে। সামান্য এই পরিবর্তন ঘটলেই গ্রহাণুর গন্তব্য অনেকখানিই বদলে যাবে।
নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য গ্রহাণুকে ধ্বংস করা নয় বরং তার গতিপথ পরিবর্তন করা। এবং এতে তারা সফল হবেন বলেই আশা করছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ