শীতে কোথাও কোথাও পদ্মার ধারা শীর্ণ হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে নদীর বুকে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করে সাধারণ মানুষ। ফসল চাষ ছাড়াও শুরু হয় ভূমির নানামুখী ব্যবহার। কিন্তু দখলদাররা এই সময়টাতে নদীর ওপর চড়াও হয় এবং দাবি করে যে, আসলে সেখানে কোনো নদী নেই। রাজশাহী জেলায় এবার পদ্মা নদীতে ঘটেছে এমনই এক অপরাধের ঘটনা।
পদ্মা নদীর বুকে রাস্তা নির্মাণ করেছেন এক বালু ব্যবসায়ী। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। নদী থেকে উত্তোলিত বালু পরিবহনের জন্য তিনি নগরীর তালাইমারী এলাকা দিয়ে নদীর উপরে এই রাস্তা নির্মাণ করছেন। নদীর বুকে রাস্তা নির্মাণ করে কোনো অনিয়ম করেননি বলে দাবি ওই নেতার। তার দাবি, যেহেতু এখন সেখানে কোনো নদী নেই, তাই রাস্তা করার কোনো বাধা থাকার কথা না।
পদ্মা নদীতে রাস্তা নির্মাণ করা এই আওয়ামী লীগ নেতার নাম রজব আলী। তিনি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জানা গেছে, রজব আলী এই বছর রাজশাহীর ‘দিয়াড়খিদিরপুর’ ও ‘চরশ্যামপুর’ বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন। কিন্তু তিনি বালু উত্তোলন করছেন ইজারা নেওয়া বালুমহালের ৬/৭ কিলোমিটার দূরে তালাইমারি এলাকায় [কাজলা মৌজা]। দুটি ড্রেজিং মেশিন দিয়ে সেখনে বালু তোলা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহী নগরের তালাইমারী ঘাট থেকে খানিকটা দূরে পদ্মা নদীর চর জেগেছে। ওই চরের পর (দক্ষিণে) নদীর মূল ধারা প্রবাহিত। ওই চরে ড্রেজিং করে বালু মজুদ করা হচ্ছে। সেখান থেকে সরাসরি ট্রাকে করে বালু আনতেই নদী ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। রাস্তা তৈরি করতে গত মঙ্গলবার থেকে নদীর বাঁ তীর থেকে ইট ও কংক্রিটের বর্জ্য ফেলার কাজ চলছে বলে স্থানীয়রা জানান।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, গত বছর একইভাবে নদী ভরাট করে রাস্তা করা হয়েছিল। ওই সময় এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হন। এছাড়া স্থানীয় এক ব্যক্তির করা রিটে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন তালাইমারী ঘাট দিয়ে বালু তোলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ইজারাদারকে রাস্তা অপসারণ করে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল।
পদ্মা পাড়ের বাসিন্দারা জানান, শীত এলে নদীর ধারা হীর্ন হয় কোনো কোনো এলাকায়। আর পদ্মা অনেক বড় নদী। শীতের সময় কেবল এর মূল ধারায় পানি থাকে। নদীর মধ্যে বিভিন্ন অংশে চর ওঠে আবার ডোবে। ফলে এক বছর যে জায়গাকে নদীর মধ্যে মনে হয় অন্য বছর শীত মৌসুমে সে জায়গায় পানি নাও দেখা যেতে পারে। যে এলাকায় নদীতে রাস্তা তোইরি করা হয়েছে, চর জাগায় এবার নদীর মূল ধারা এখান থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছে। তবে এর বাঁ তীর ঘেঁষে রয়েছে জলধারা।
স্থানীয়রা জানান, যে এলাকায় নদীতে হাত দেয়া হয় সেখানেই নদীর ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে। নদী দখল হয় কিংবা আরও শীর্ণ হয়ে পড়ে। নদীতে এ ধরনের বালু তোলার কাজ চললে, অন্য সময় সাধারণ মানুষ নদী ব্যবহার করার যেটুকু সুযোগ পান, সেটাও থাকে না। অন্যদিকে শীতে এভাবে বালু উত্তোলনে এই এলাকায় বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়া এই পথে বালু পরিবহন করা হলে ব্যস্ততম তালাইমারি এলাকা বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে যাবে বলেও এলাকাবাসীর আশঙ্কা।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বালু মহালের ইজারাদার ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “চর থেকে বালু তুলে নিয়ে আসার জন্য ওই রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে এখন নদী নেই। তাই কোনো অনিয়ম করছি না।” ইজারা নেওয়া স্থান থেকে বালু না তুলে তালাইমারী থেকে কেন তুলছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, সঠিক জায়গা থেকেই তিনি বালি তুলছেন। তিনি বলেন, তার ইজারা নেওয়া জায়গা থেকে বালু তুলে নৌকায় করে এখানে জমা করছেন। তারপর এই পথ দিয়ে বালু বাইরে নিচ্ছেন। এ কারণে রাস্তা তৈরি করছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহীর সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পানি থাকুক আর না থাকুক, নদীর জায়গায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না। এটা দেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ আইনে জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নদী রক্ষা কমিশনের জেলা ও বিভাগীয় কমিটি ব্যবস্থা নিতে পারে। জেলা প্রশাসক নদী রক্ষা কমিশনের জেলা কমিটির সভাপতি এবং বিভাগীয় কমিশনার বিভাগীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নজরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর ২৮ নভেম্বর ২০২০ শনিবার সংশ্লিষ্ট ইজারাদারকে রাস্তা নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে রাস্তার জন্য যে মাটি বা ইট-সুরকি ফেলা হয়েছে, সেগুলোও সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে জানা যায়, গত বছর ‘চরশ্যামপুর’ ও ‘চরখিদিরপুর’ বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছিল। তাই তালাইমারি ঘাট দিয়ে বালু উত্তোলনের সুযোগ ছিল।
কিন্তু ওই ঘাট দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধে হাই কোর্টে রিট করা হয়। ওই রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছর সেখান দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে চলতি বছরের ৩ মে বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এই বালুমহালটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে সভায় ‘দিয়াড়খিদিরপুর’ ও ‘চরশ্যামপুর’ নামে নতুন বালুমহাল করা হয়, যা তালাইমারি এলাকা থেকে প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার দূরে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী সেই সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করেই বাতিলকৃত বালুমহাল থেকে বালু উত্তলোনের জন্য নদীতে রাস্তা নির্মাণ করেছেন। আদালতের নির্দেশনা ভঙ্গ ও নদী দখল, রাস্তা নির্মাণ ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মতো অনেকগুলো অপরাধ এখানে সংঘটিত হলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেনি। জেলা প্রশাসনও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে হাঁটেনি।
এসডাব্লিউ/আরা/১১২০
আপনার মতামত জানানঃ