বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত দুর্নীতির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন দাবি করেছে বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। সংস্থাটি মঙ্গলবার গর্ভনমেন্ট ডিফেন্স ইন্টিগ্রিটি ইনডেক্স বা সরকারি প্রতিরক্ষা শুদ্ধাচার সূচক ২০২০ প্রকাশ করে। টিআই বাংলাদেশের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
একটি দেশের সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সার্বিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও কাঠামোতে দুর্নীতির ঝুঁকি কতোটা, ঝুঁকি কমাতে কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নীতিকাঠামো ও চর্চা বিদ্যমান এবং সেগুলো কতটা কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক এমন সব বিষয় বিবেচনা করে সংস্থাটি বলছে, প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ‘অতি দুর্বল’।
৭৭টি জিজ্ঞাসার বিপরীতে ২১২টি নির্দেশকের ভিত্তিতে একটি দেশের প্রতিরক্ষা খাতের পাঁচটি ঝুঁকির ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করে জিডিআই ২০২০ সূচকটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পাঁচটি ঝুঁকির ক্ষেত্র হল: রাজনৈতিক, আর্থিক, জনবল, পরিচালনা এবং ক্রয়।
এসব ক্ষেত্রে একটি দেশের প্রাপ্ত নম্বরকে (০ থেকে ১০০ স্কেলে) ‘এ’ থেকে ‘এফ’ শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ‘এ’ শ্রেণী হল সবচেয়ে কম ঝুঁকিসম্পন্ন এবং ‘এফ’ শ্রেণী হল সংকটজনক দুর্নীতির ঝুঁকিসম্পন্ন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ‘অতি দূর্বল’। ৮৬টি দেশ নিয়ে প্রকাশিত এই সূচক অনুযায়ী ৬২ শতাংশ দেশেরই প্রতিরক্ষা খাত উচ্চ থেকে সংকটজনক দুর্নীতির ঝুঁকিতে রয়েছে।
টিআই জানিয়েছে, সূচকের ফলাফল অনুযায়ী ৮৫ স্কোর করে প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির সবচে কম ঝুঁকিতে রয়েছে নিউজিল্যান্ড। এরপরেই রয়েছে যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে (স্কোর ৭৬), বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস (স্কোর ৭৩)। আর ৫ স্কোর করে সর্বোচ্চ সংকটজনক দুর্নীতির ঝুঁকিতে রয়েছে সুদান। এরপরেই রয়েছে মিসর (স্কোর ৬), মিয়ানমার ও আলজেরিয়া (স্কোর ৮) এবং ইরাক (স্কোর ৯)।
টিআই বলছে, জিডিআই সূচকে কম নম্বর পাওয়া দেশগুলোতে প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে থাকা সুরক্ষা পদ্ধতি বা কার্যক্রম দুর্বল কিংবা অস্তিত্বহীন। বলা চলে, একই সাথে এসব দেশ অস্থিতিশীল, সঙ্ঘাতপূর্ণ কিংবা তার জনগণ শোষণের শিকার।
সার্বিকভাবে ২৫ স্কোর করে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত এ সূচকে দুর্নীতির অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সূচকে বিচার্য পাঁচটি ঝুঁকি ক্ষেত্রের মধ্যে বাংলাদেশ সবচে বেশি স্কোর করেছে সামরিক জনবল ব্যবস্থাপনায়, স্কোর ৫২। আর সবচেয়ে খারাপ স্কোর ০ (শূন্য) পেয়েছে পরিচালনা ঝুঁকির ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ঝুঁকিতে স্কোর ২৬, আর্থিক ঝুঁকিতে স্কোর ১৯ আর সামরিক ক্রয়ে দুর্নীতির ঝুঁকিতে স্কোর ২৯।
সূচকে বাংলাদেশের এমন ফলাফলে উদ্বেগ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ সূচক বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি বিরাজ করছে, এমন কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ দিচ্ছে না; তবে খাতটিতে শুদ্ধাচার ঘাটতি ও দুর্নীতির ব্যাপক ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছে। অতএব সূচকের ফলাফলকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা শুদ্ধাচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এবং তার মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্নীতির প্রতিরোধক সক্ষমতা কাঠামো সুদৃঢ় করা অপরিহার্য।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে প্রথম ও অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল-২০১০-এর ধারাবাহিকতায় একটি প্রতিরক্ষা শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন ও তার চর্চা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট খাতে বিশেষজ্ঞজনের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের মতো সব অংশীজনকে সম্পর্কিত করলে এর গ্রহণযোগ্যতা ও জাতীয় মালিকানাবোধ বাড়বে।’
প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ‘অতি দূর্বল’। ৮৬টি দেশ নিয়ে প্রকাশিত এই সূচক অনুযায়ী ৬২ শতাংশ দেশেরই প্রতিরক্ষা খাত উচ্চ থেকে সংকটজনক দুর্নীতির ঝুঁকিতে রয়েছে।
জিডিআইয়ের ফলাফল বলছে, বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বলে প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলোর পরিচালনা কার্যক্রম গোপনে পরিচালনার যে রীতি অনুসৃত হয়ে আসছে, তা মোটেই সঠিক নয়। বরং গোপনীয়তা কোনোভাবেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তার জন্য প্রযোজ্য শর্ত নয়, এটি মূলত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যেমন নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য জিডিআই সূচকে উচ্চ স্কোর করেছে। এটি প্রমাণ করে যে একটি দেশের সরকার যত বেশি অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হয়, সেখানে প্রতিরক্ষা খাত তত বেশি স্বচ্ছ এবং দুর্নীতির ঝুঁকিও কম। একইভাবে জিডিআই স্কোরের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্সের তুলনা বলছে, যারা উন্মুক্ত সরকারের সূচকে ভালো ফল করেছে, তারা প্রতিরক্ষা খাতের স্বচ্ছতায়ও বেশি নম্বর পেয়েছে।
জিডিআই সূচকের বিশ্লেষণ বলছে, সামরিক বা প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং এ খাতের দুর্বল শাসন বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ক্ষেত্রে জিডিপির ১ ভাগ সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি মানে জিডিআই স্কোর ৫ পয়েন্ট কমে যাওয়া। এটি প্রমাণ করে যে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি দুর্বল শাসনের ক্ষেত্রে হয়তো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা রাখে। যেটি বিদ্যমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাকে ব্যবহার করে দুর্নীতির সুযোগ বা ঝুঁকি তৈরি করে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এটি খুবই হতাশাজনক যে বিশ্বে সামরিক ব্যয় এখন বার্ষিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপকতাকে বাড়িয়ে চলেছে।
জিডিআইয়ের তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের ৮৬ ভাগই হয়েছে সেসব দেশ থেকে, যেসব দেশের প্রতিরক্ষা খাত মধ্যম থেকে উচ্চ দুর্নীতির ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে। শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র (৫৫), রাশিয়া (৩৬), ফ্রান্স (৫০), জার্মানি (৭০) এবং চীন (২৮)। এই পাঁচ দেশ বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যের ৭৬ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বিশ্বের মোট অস্ত্র আমদানির ৪৯ শতাংশের গন্তব্যই ছিল প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির ‘উচ্চ’ থেকে ‘সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশগুলোতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে এবং দিনে দিনে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ব্যবহার কোথায় হচ্ছে এবং কারা ভোগ করছে, তা সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই সংশ্লিষ্ট সবার ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করলেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি থাকায় এর সুফল জনগণ সঠিকভাবে পাচ্ছেন না। তবে দুর্নীতি না থাকলে আমাদের দেশ অনেক আগেই মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ হয়ে উঠত, সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
তারা বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সবার প্রিয় এ দেশে যত সমস্যা জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দাঁড়াচ্ছে, দুর্নীতি তার মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যাধিক্য ও ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটির একদিকে যেমন বিরাজ করছে সম্পদের অভাব, তেমনি অপরদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিরাজ করছে দুর্নীতির কালো ছায়া।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখানো; দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
তা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সব কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যথাযথ ব্যবস্থা করা, দারিদ্র্য বিমোচন ও আয়বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং দুর্নীতি বিষয়ক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি।
পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদেরকে শুধু ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করাসহ তাদেরকে সামাজিকভাবে বর্জন করার ব্যবস্থা করা দরকার।
তারা আরও বলেন, দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংস্কার, সুশীল সমাজ গঠন, ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন ও তা দূর করতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আবশ্যক। এ ছাড়া গণমাধ্যমকে প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় সম্পৃক্ততা বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৭
আপনার মতামত জানানঃ