কথিত ‘সংখ্যালঘুবান্ধব’ ও হিন্দুদের আস্থার প্রতীক আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে প্রায় সাড়ে ১২ বছর ক্ষমতায় আছে। দেশে বরাবরই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও এখন মূলত রাজনৈতিক অস্থির অবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এ ধরনের ঘটনা। বাংলাদেশ যতই তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে সরে যাচ্ছে, ততই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বাড়ছে৷ আর তার পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামে নৌকা প্রতীকে সমর্থন না দেওয়ায় লালমনিরহাটে চলবলা ইউনিয়নে এক হিন্দু পরিবারের সদস্যদের মারধর ও তাদের বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজানুর রহমান মিজুর বিরুদ্ধে।
হামলায় আহতরা হলেন— তেঁতুলিয়া গ্রামের উপেন্দ্র নাথ বর্মণের ছেলে তপন চন্দ্র রায় (৩২), তার স্ত্রী নয়ন রানী রায় (২৪) ও তার মা শান্তি বালা (৫০)। তাদের লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তপনের স্ত্রী নয়ন রানী রায় অভিযোগ করেন, ‘আমার স্বামী আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজানুর রহমান মিজুর পক্ষে সমর্থন জানাতে অস্বীকৃতি জানান। এতে মিজু ও তার লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে আমার স্বামীকে মারধর শুরু করেন। তাকে রক্ষা করতে আমি ও আমার শাশুড়ি ছুটে গেলে আমাদেরকেও মারধর করা হয়।’
তপন চন্দ্র রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাকে এলোপাথারি মারধর করা হয়। আমি শুধু বলেছিলাম, আমি আমার পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবো। এতেই মিজানুর রহমান মিজুর নির্দেশে তার লোকজন আমার বাড়ির বেড়া ও দরজা ভাঙচুর করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ সময় তারা আমাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ গ্রাম ছাড়ার হুমকি দিতে থাকেন। মিজু ও তার লোকজনের ভয়ে আমরা কালীগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি।’
অভিযোগ অস্বীকার করে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মিজানুর রহমান মিজু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি তেঁতুলিয়া এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গেলে তপন চন্দ্র রায় বাঁধা দেন। এতে আমার সমর্থকদের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। সেখানে মারধর বা বাড়ি ভাঙচুরের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার বিপক্ষে জনমত তৈরি করতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তপনের পরিবারকে ব্যবহার করে মিথ্যা ও সাজানো ঘটনা প্রচার করছেন।’
এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
কালীগঞ্জ থানার ওসি বলেন, ‘এ ঘটনায় তপনের পরিবার একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। তদন্তে সত্যতা পেলে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
‘এ সময় তারা আমাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ গ্রাম ছাড়ার হুমকি দিতে থাকেন। মিজু ও তার লোকজনের ভয়ে আমরা কালীগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি।’
গত ১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগ ওঠে, যার জেরে দেশজুড়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মণ্ডপ, মন্দির, বাড়িঘর এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, এখন তাদের বাংলাদেশে নিরাপদে বসবাস করা বা নিরাপত্তার প্রশ্নে শঙ্কা আরও বেড়েছে।
সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মদদেই হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের ওপর এসবের দায় চাপিয়ে তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে মানুষের মননে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই সরকারের শাসনামলেই পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ, কওমি জননী উপাধি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের তৈরি করা জমিতেই এখন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের চাষ হচ্ছে।
তারা বলছেন, শাসক দলের পরিচিতি বা সমর্থন ছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ খুবই কম৷ নেই বললেই চলে৷ তাই এই ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা সব সময়ই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকতে চায়৷ যেহেতু এই মুহূর্তে বাংলাদেশে শাসক দলের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির তেমন কোনো অবস্থান নেই বললেই চলে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা সরকারি দলের লোকেরা ছাড়া কেউ করতে পারে না।
তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উসকানি দিতে দেখা গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির পাহারাদার। এদের দিয়ে প্রগতিশীলতা রক্ষা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে না। সারা দেশে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করা, এর সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের গ্রেপ্তার-বিচার করা এবং হামলা-লুটপাটের দায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনকে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে বড় হয়ে ওঠে কারা তাদের ভোট পাবে, কারা পাবে না। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। নব্বই ও বিরানব্বইয়ের পর ২০০১ সালে এবং রামু, সাথিয়া, নাসিরনগরের ঘটনায় এর প্রমাণ মিলেছে। নির্বাচিত দল বা সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঐ সময়ের বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৯
আপনার মতামত জানানঃ