দেশে বর্তমানে প্রায় ১৬ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী রয়েছে। এর সঙ্গে প্রতি বছর নতুন করে যোগ হয় দুই লাখ রোগী। এই পরিসংখ্যানে বোঝা যায়, ক্রমাগত নারীদের মধ্যে বাড়ছে স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা। আর এর কারণ দ্রুত নগরায়ন, দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা, সপ্তাহে তিন বারের বেশি ফাস্টফুড খাওয়া, স্থূলতা এবং বেশী মাত্রায় প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার।
গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর বিএমএ ভবনের সভা কক্ষে ‘স্তন ক্যান্সারে পেশাগত ঝুঁকি’ বিষয়ক একটি সচেতনতামূলক গোলটেবিল বৈঠক হয়। সেখানে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। পাশাপাশি এই বৈঠকে কিছু বিষয়ে সচেতন হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। বাংলাদেশ ক্যান্সার স্ট্যাডি গ্রুপ ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টস ফোরাম যৌথভাবে গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করেছে।
বৈঠকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “গত ৪০ বছরে সবচেয়ে বেশি নগরায়ন হয়েছে বাংলাদেশে। কর্মজীবীদের মধ্যে প্লাস্টিকের বোতলে পানি পানের প্রবণতা বেশি। তবে একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতলের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পানের ফলে মুখের লালার সঙ্গে প্লাস্টিকের স্পর্শে ‘বিপিএ’ নামের এক ধরনের বিষক্রিয় আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, এর ফলে নারীদের স্তন ক্যান্সার ঝুকি ৩ শতাংশ বেড়ে যায়।”
তিনি বলেন, দেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের হার ব্যাপক। ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্যান্সার শনাক্ত হয় চতুর্থ স্তরে গিয়ে।
গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, “দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন দরকার। কারণ দেশে প্রায় ৫০ বছর আগে ক্যান্সারের চিকিৎসা সেবা শুরু হলেও রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী সেবার মান ও পরিধি বাড়েনি।”
তিনি বলেন, “দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটা করে ক্যান্সার কেন্দ্র দরকার। সে হিসেবে ১৬০টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে সচল ও বিকল মিলে আছে মাত্র ২০টি কেন্দ্র। যা চাহিদা অনুযায়ী খুবই কম।”
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রায় ১৬ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী রয়েছে। এর সঙ্গে প্রতি বছর নতুন করে যোগ হয় দুই লাখ। এই রোগীদের ৭০ শতাংশই চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা জাতীয় রাজস্বের অপচয় হচ্ছে। যেটা জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ।”
স্তন ক্যানসার কেন হয়?
১. প্রথমত এর জন্য দায়ী আমাদের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন। যেমন আজকাল আমরা প্রচুর ফাস্ট ফুড খাই, সবুজ শাকসবজি খুবই কম খাই, কম শারীরিক পরিশ্রম করি। যার ফলে আমরা অতিরিক্ত স্থূলতায় ভুগছি। অতিরিক্ত স্থূলতা স্তন ক্যানসারের এক অন্যতম প্রধান কারণ।
২. দেরিতে সন্তান নেওয়া।
৩. শিশুকে বুকের দুধ দিতে অনীহা বা অপারগতা (যেমন চাকরিজীবী নারীরা এ সমস্যায় ভোগেন বেশি)।
৪. বেশি বয়স, গড় আয়ু বেড়ে যাওয়াতে এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
৫. বগলে চাকা দেখা দেয়া।
যদি স্তন ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে তার উপসর্গ দেখা দেয়া যেমন-
১. যকৃতে ছড়ালে পেটে ব্যথা বা জন্ডিস দেখা দেয়।
২. ফুসফুসে ছড়ালে কাশি হওয়া এমনকি কাশির সঙ্গে রক্তও যেতে পারে।
৩. হাড়ে ছড়ালে সেখানে তীব্র ব্যথা হওয়া।
উপসর্গ
১. স্তনে চাকা দেখা দেয়া।
২. স্তনের চামড়ার রং পরিবর্তন হওয়া বা চামড়া মোটা হওয়া (কমলালেবুর খোসার মতো)।
৩. নিপল বা স্তনের বোঁটা ভেতরে দেবে যাওয়া।
৪. নিপল দিয়ে রক্ত বা পুঁজ পড়া।
ডায়াগনোসিস বা শনাক্তকরণ পরীক্ষা
প্রথমেই বিশেষজ্ঞরা রোগীর রোগের হিস্ট্রি নিয়ে থাকেন। শারীরিক পরীক্ষা করেন। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যানসার শনাক্ত করা হয়। রোগীর বয়সের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখেই বিশেষজ্ঞরা তা দিয়ে থাকেন। যেমন: ম্যামোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই, FNAC -চাকা থেকে, বায়োপসি/মাংস পরীক্ষা।
চিকিৎসা
২. প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ রোগী সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা প্রধানত কয়েক ভাগে বিভক্ত-
৩. সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি।
৪. হরমোন থেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপি।
সার্জারি
স্তন ক্যানসারের যে কোনো পর্যায়েই রোগীর সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারি করা যাবে কিনা বা কী ধরনের সার্জারি হবে তাই প্রাথমিক বিবেচ্য বিষয়। সিদ্ধান্ত নেবেন সার্জন এবং ক্যানসার বিশেষজ্ঞ দুজনে মিলে। অনেক সময় শুধু টিউমার কেটে ফেলা হয়। অনেক সময় পুরো বেস্টই ফেলে দেয়া হয়।
কেমোথেরাপি
প্রায় সব রোগীকেই কেমোথেরাপি নিতে হয়। সার্জারির আগে বা পরে এমনকি রোগ শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়লেও কেমোথেরাপি কাজ করে। যদিও কেমোথেরাপিতে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে তবুও রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য কেমোথেরাপির বিকল্প নেই। রোগীর শারীরিক অবস্থা, কেমোথেরাপির কার্যকারিতা, রোগীর আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়েই ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা উপযুক্ত পরামর্শ দেন। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাতে কম হয় তারও ব্যবস্থাপত্র দেন চিকিৎসকরা।
রেডিওথেরাপি
বিশেষ ধরনের মেশিনের মাধ্যমে রোগীদের রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দেয়া হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সাধারণ কেমোথেরাপির পরই রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। রেডিও থেরাপি দিয়ে হাড়ের ভাঙন বা ফ্র্যাকচারও রোধ করা যায়।
হরমোন থেরাপি
সব ব্রেস্ট ক্যানসারের রোগীর জন্য হরমোনের দরকার নেই। ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই হরমোনের চিকিৎসা কাদের লাগবে তা শনাক্ত করেন।
টার্গেটেড থেরাপি
এ থেরাপি রোগীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। যেমন- Transtyuumab, Lapatinib, Bevacizumab ইত্যাদি।
করণীয়
ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং জরুরি। ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে সবারই জানা উচিত এবং এই প্রোগ্রামের আওতায় আসা উচিত। তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়বে এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হবে।
আমাদের সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা এবং জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন হলে (যা ক্যানসার রোগের কারণ) এ রোগের প্রকোপ অনেকাংশেই কমে আসবে এবং আমাদের সমাজে সুস্থ-সুন্দর জীবনের অধিকারী মানুষের অবস্থান সুদৃঢ় হবে।
স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিতে আছেন যারা
বয়স্ক নারী, যাদের স্তন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস আছে, যেসব নারীরা সন্তানকে বুকের দুধ পান করাননি BRCA-1, BRCA-2 নামক জিনের মিউটেশনের কারণে, অল্প বয়সে মাসিক শুরু হওয়া, দেরিতে মাসিক বন্ধ হওয়া, মদ্যপান করলে, স্তনের কিছু অসুখ যেমন atypical ductal বা lobular hyperplasia থাকলে। এছাড়া অন্য কোনো ক্যানসার যেমন- কোলন, ডিম্বাশয়ে ক্যানসার হলে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ