আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে উত্তেজনা বাড়ছে কাশ্মিরে। কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি হামলার নতুন কৌশলে দুশ্চিন্তা বেড়েছে প্রশাসনে। জঙ্গিরা এবার চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। পাঁচদিনে সাতজন সাধারণ মানুষের হত্যার পর জম্মু-কাশ্মির জুড়ে তল্লাশি অভিযানে নেমেছে পুলিশ। অভিযানে ইতোমধ্যে দুই বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন আরও ৭০০ জন।
আটকদের অনেকেরই নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াত-ই-ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এদের আটক করা হয়েছে শ্রীনগর, গান্দেরবাল, বাদগাম এবং দক্ষিণ কাশ্মীরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এদের কাশ্মীর উপত্যকায় হামলার ঘটনায় আটক করা হয়েছে। আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতায় ফেরার পর কট্টরপন্থার উত্থানও সাম্প্রতিক আক্রমণের কারণ হতে পারে। খুনিরা এখন সহজ টার্গেট করছে।’
পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক আনন্দবাজার ও জার্মানির সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের (ডিডব্লিউ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী খোঁজে কাশ্মিরের বেশ কয়েকটি জায়গায় যৌথভাবে তল্লাশি চালাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও কাশ্মির পুলিশ। তল্লাশির সময় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে কাশ্মিরের অনন্তনাগ ও বান্দিপোরায় মৃত্যু হয় দুই জঙ্গির।
অনন্তনাগে নিহত বিচ্ছিন্নতাবাদীর নাম ইমতিয়াজ আহমেদ দার। সে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিসংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার সদস্য হিসেবে কাজ করত কাশ্মিরে। তবে বান্দিপোরায় নিহত জঙ্গির নাম এখনও জানা যায়নি।
এদিকে, গত দু’দিনে বিচ্ছিন্নতাবাদে সংশ্লিষ্টতা ও তাতে মদত দেওয়ার অভিযোগে ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী। তারা সবাই কাশ্মিরের নিষিদ্ধ সংগঠন জামাত-ই-ইসলামির সমর্থক বলে জানিয়েছেন বাহিনীর কর্মকর্তারা।
জার্মানির সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগামী কিছুদিনের মধ্যে আরও হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে কাশ্মিরে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই এই ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
গত একমাস ধরে কাশ্মির উত্তপ্ত হয়ে আছে। তবে গত সপ্তাহে চরমে পৌঁছেছে এই উত্তেজনা। একের পর এক সাধারণ মানুষকে খুন করতে শুরু করেছে জঙ্গিরা। অভিযোগ, বেছে বেছে হিন্দু পণ্ডিত এবং শিখদের খুন করা হচ্ছে। যদিও যে সাতজনকে হত্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে মুসলিমও আছে। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে খুন করে তারা কাশ্মিরে উত্তেজনা জারি রাখতে নিরস্ত্র সাধারণ এসব মানুষকে তারা খুন করছে বলে অভিযোগ।
পাঁচদিনে সাতজন খুন হওয়ার পরে নড়েচড়ে বসে ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসন। দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জরুরি বৈঠক ডাকেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের এনএসএ অজিত ডোভাল। এরপরেই কাশ্মীরে একটি বিশেষ দল পাঠায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। কাশ্মীর পুলিশের সঙ্গে সেই দল তল্লাশি অভিযান শুরু করে। তারপরই গত দুইদিনে ৭০০জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
‘আগামী কিছুদিনের মধ্যে আরও হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে কাশ্মিরে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই এই ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
কাশ্মির পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ডিডব্লিউকে জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে উত্তেজনা বাড়ছে কাশ্মিরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মানুষ তালিবানকে সমর্থন জানিয়ে পোস্ট করেছে। কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনও নতুন করে সক্রিয় হয়েছে।
তারই জেরে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষকে টার্গেট করা হচ্ছে। গত এক বছরে ২৮টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সাতটি ঘটেছে গত সপ্তাহে।
সম্প্রতি স্কুলে জঙ্গিহানার পর থেকেই অশান্ত কাশ্মীর। টার্গেট কিলিংয়ের জেরে কার্যত দলে দলে সংখ্যালঘুরা উপত্যকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলেই খবর। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, আতঙ্কের রেশ প্রবল। কাশ্মীরে শিক্ষক-মৃত্যুর ঘটনায় ১৬টি জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে এনআইএ। পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে নিরাপত্তাবাহিনীও পাকড়াও করেছে বেশ কয়েকজনকে।
জানা গেছে, প্রায় ৯০০ জনকে আটক করেছে তারা। এই ৯০০ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছেন যুবকরা। কাশ্মীরের ডিআইজি দিলবাগ সিং আগেই জানিয়েছিলেন যে, কাশ্মীরে বিভেদ সৃষ্টি করতে নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে লক্ষ্য করে হত্যার স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলি।
এই অবস্থায়, উপত্যকায় বড়সড় তল্লাশি অভিযান জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ)। জোড়া মামলায় কাশ্মীরের প্রায় ১৬টি জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালায় এনআইএ। আইএস-এর ভারতীয় মুখপত্র হিসাবে পরিচিত ‘ভয়েজ অব হিন্দ’-এর তথ্য জানতে এবং সাম্প্রতিককালে উপত্যকায় সাধারণের উপর জঙ্গি হামলায় অভিযুক্ত দ্য রেজিসট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)-এর সদস্যদের বাড়িতেও তল্লাশি চালান এনআইএ-র গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে সাম্প্রতিক সাধারণ মানুষের উপর জঙ্গি হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ৭০০ জনকে আটক করেছে। তার মধ্যে অনেকেই যুবক।
জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর ভারতীয় মুখপত্র ‘ভয়েজ অব হিন্দ’। ২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই জঙ্গি সংগঠনটি মাসিক অনলাইন পত্রিকাটি প্রকাশ করছে। কাশ্মীর উপত্যকায় যুবকদের আরও বেশি করে ধর্মীয় মৌলবাদী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে ওই পত্রিকার প্রবল প্রভাব দেখছেন গোয়েন্দারা। সেই সূত্রেই শ্রীনগর, অনন্তনাগ, বারামুলা, কুলগামের বিভিন্ন ঠিকানায় অভিযান চালায় এনআইএ।
এদিকে, কাশ্মির পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ এবং মেহবুবা মুফতি। দুইজনেই এই পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জবাব চেয়েছেন। ফারুক আবদুল্লাহের দাবি, নরেন্দ্র মোদীর এই পরিস্থিতিতে কাশ্মিরে আসা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নব্বই দশকের পর কাশ্মির এতটা উত্তপ্ত হয়নি। নব্বইয়ের দশকে হত্যা, লড়াইয়ের ঘটনা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ফের তেমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। দ্রুত স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে এর সমাধানসূত্র খোঁজা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৪
আপনার মতামত জানানঃ