আধুনিক সভ্যতার এই যুগে প্রতিটি মানুষ যেন যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে।প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হতে হচ্ছে নানা ধরনের বাঁধা আর জটিল সমস্যার।মানুষের জীবনের এই জটিল সমস্যাগুলো দিন দিন মানুষের জীবনকে আরো কঠিন করে দিচ্ছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিষণ্নতা এবং আরো নানা ধরনের মানসিক অসুস্থতায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।ফলস্বরূপ, বর্তমান বিশ্বে সুইসাইডের হার বেড়েই চলছে।
বিষণ্ণতা ও অবসাদের এমন মহামারিতে আশার কথা হলো, নিউরাল পেসমেকারের মতো কাজ করা ডিভাইস মস্তিষ্কে স্থাপনের মাধ্যমে এক রোগীর গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা দূর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার ওই গবেষকরা জানান, নিউরাল ইলেকট্রনিকসকে ভালোভাবে লক্ষ্য করার মাধ্যমে মানসিক রোগ চিকিৎসায় বৈজ্ঞানিক এ প্রচেষ্টা এক ‘মাইলফলক সফলতা’।
এ সফলতা নিয়ে চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী নেচার মেডিসিনে গবেষকদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্র যে শুধু মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে প্রয়োজনে সক্রিয় করে তুলতে পারে, তা-ই নয়; মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের ভেতরে বিদ্যুৎতরঙ্গের পরিমাণ আর তার কমা-বাড়ার ওপরও কড়া নজর রাখতে পারে। নতুন এই চিকিৎসা পদ্ধতি সুস্থ হয়ে সারাহ বলেন, তার জীবন সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। তিনি নতুন জীবন পেয়েছেন।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু ক্রিস্টাল বলেন, ‘রোগীর মস্তিষ্কের সার্কিট শনাক্ত ও সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা সফলভাবে তার চিকিৎসা প্রতিরোধী বিষণ্নতা দূর করতে পারি।’
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের আগে ৩৬ বছর বয়সী ওই রোগী এক টেলিকনফারেন্সে বলেন, ‘টানা পাঁচ বছর ভয়াবহ বিষণ্নতায় ভুগেছিলাম। কোনো ওষুধ বা ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপিতে কাজ হয়নি। প্রতিদিন আত্মহত্যার চিন্তা আমাকে যন্ত্রণা দিত। মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক ডিভাইস স্থাপন আমার জীবন পরিবর্তন করে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘মস্তিষ্কে প্রবেশের পরপরই যন্ত্রটি আমাকে এক ধরনের প্রশান্তি দেয়। এ প্রশান্তি এক বছর ছিল। যুক্তিহীন চিন্তা করা নিউরালের কর্মকাণ্ড শনাক্তের পর যন্ত্রটির ইলেকট্রোড স্বল্প সময়ের জন্য সংশোধনমূলক বৈদ্যুতিক স্পন্দন পাঠায়। এর পরই চক্রটি থেমে যায়।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, মৃগীরোগ ও পারকিনসন রোগ চিকিৎসায় ডিপ ব্রেইন স্টিমিউলেশন (ডিবিএস) সম্প্রতি বেশ প্রচলিত। তবে বিষণ্নতা চিকিৎসায় ডিবিএস খুব একটা সফল নয়। বিষণ্নতায় ভোগা রোগীদের ৩০ শতাংশ প্রচলিত চিকিৎসার সহায়তা নেন না।
মৃগীরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডিবিএস যন্ত্র কিছুটা পরিবর্তন করেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা। এরপর এটি বিষণ্নতার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
অ্যামিগডালা নামে পরিচিত মস্তিষ্কের নিউরাল কর্মকাণ্ডের বিশেষ প্যাটার্নের বায়োমেকার শনাক্ত করে যন্ত্রটি। এরপর এটি মস্তিষ্কে সুখানুভূতি দেয়া ভেন্ট্রাল স্ট্রিটামকে ছোট বৈদ্যুতিক স্পন্দন পাঠায়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে বিষণ্নতার লক্ষণ দূর হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বেইলর কলেজ অফ মেডিসিনের নিউরোসার্জন সামির শেঠ ওই গবেষণা দলে ছিলেন না। তবে বিষণ্নতা চিকিৎসায় তিনি আরেকটি পরীক্ষা করছেন।
সামির বলেন, ‘মনোরোগ চিকিৎসায় চলমান দুটি গবেষণা ইতিবাচক ফল দেবে বলে আমার ধারণা।’
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ক্যাথরিন স্ক্যানগস বলেন, ‘ভয়াবহ বিষণ্নতায় ভোগা আরও দুই রোগীকে আমাদের গবেষণার অংশ করা হয়েছে। সব মিলে এ গবেষণায় ১২ রোগী অংশ নিচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘বৈদ্যুতিক ডিভাইস ভিন্ন ভিন্ন রোগীর চিকিৎসায় কী ধরনের প্রভাব ফেলে, তা একবার নয়, কয়েকবার পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় কোনো রোগীর বায়োমেকার বা মস্তিষ্কের সার্কিটের পরিবর্তন হয় কি না, তাও দেখা জরুরি।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদ্ধতি একটি অভিনব উদ্ভাবন। এর ফলে গভীরভাবে মানসিক অবসাদে দীর্ঘদিন ধরে ভোগা রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে, যা এত দিন কোনো চিকিৎসায়ই করা যেত না। ডর্টসমাউথের গাইসেল স্কুল অব মেডিসিনের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পল হোলঝহেমার বলেছেন, এটি সত্যি সত্যিই অভিনব পদ্ধতি। তবে মাত্র একজন রোগীর ওপর পরীক্ষায় সাফল্য এসেছে। ভবিষ্যতে এর বহুল ব্যবহারের জন্য আরও বহু রোগীর ওপর এই পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
এদিকে গত বেশ কিছু বছর ধরে বিশ্বের স্বনামধন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের কাছে বৈদ্যুতিকভাবে মস্তিষ্ক উদ্দীপনার একটি পদ্ধতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে যেটি মস্তিষ্কজনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। মস্তিষ্ক উদ্দীপনার বৈদ্যুতিক এই প্রক্রিয়া Transcranial Direct Current Stimulation বা সংক্ষেপে (tDCS) নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের স্ক্যাল্পসের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় ইলেক্ট্রনের প্রবাহ পাঠানো হয়।ফলে সাইন্যাপ্সের মধ্যদিয়ে এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষের বার্তা যোগাযোগ ব্যবস্থা তরান্বিত হয় এবং মস্তিস্ক তার স্বাভাবিক কর্মক্ষম অবস্থা ফিরে পায়। যার ফলে মানসিক অবসাদ দূর হয়।তবে অবশ্যই এটি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করতে হবে এবং প্রত্যেকবার এর সময়কাল ২০ মিনিটের বেশী হওয়া উচিত নয়।
এই প্রক্রিয়াটি নিউরোস্টিমুলেশন এর একটি রুপ এবং গবেষকেরা এটি খুঁজে পেয়েছেন যে, এটি বিষণ্নতা এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, এমনকি শেখার সক্ষমতা বাড়ানো, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি এবং মানুষের সৃজনশীলতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
তারা মনে করেন যে, এটি নিউরোমেডিসিনের একটি ভালো বিকল্প হতে পারে।বর্তমানে এই ধরনের tDCS ডিভাইসগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে।এমনকি ইউএস মিলিটারি তাদের ড্রোন পাইলটদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে এই ডিভাইস ব্যবহার করছে।খুব অল্প পরিমানে কারেন্ট মাথায় পাঠানো হয় বলে এর কোন খারাপ প্রভাব শরীরে পড়ে না। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ব্যথাহীন।
এই চিন্তা থেকেই ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশলের ৩জন ছাত্র মোঃ সাকিব উল্লাহ সৌরভ ,আসিফুর রহমান এবং তৌহিদ উজ জামান কয়েকটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি tDCS ডিভাইস তৈরি করেছে যা মস্তিষ্কের স্ক্যাল্পসের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় 0.5-2.5 মিলিএম্পিয়ারের মাঝামাঝি একটি ছোট পরিমাণের কারেন্ট পাস করে।ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ফকির মাশুক আলমগীর এর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় তারা ডিভাইসটি তৈরি করে।
পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানী এবং নিওরোলজিস্টরা এর কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন।তাদের ধারনা, অদূর ভবিষ্যতে নিউরোস্টিমুলেশনের এই পদ্ধতি মানুষের বিষণ্ণতা দূরীকরণ এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে বৈপ্লবিক সাফল্য নিয়ে আসবে। সেই যাত্রাপথে বাংলাদেশের মেধাবী তরুণদের এই উদ্ভাবনও অবদান রাখবে বলে আমরা আশা রাখছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৩
আপনার মতামত জানানঃ