জন্মের পর থেকে একজন ব্যক্তির যেকোনো সরকারি কাজেই লিঙ্গ পরিচয় প্রয়োজন পড়ে। তবে সেখানে পুরুষ ও নারী এ দুটি অপশনই থাকে কেবল। যদিও এবার বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, প্রথমবারের মত এখন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সময় প্রত্যেকে তার নিজের পরিচয় ব্যবহার করে ভর্তি হতে পারবে।
তৃতীয় লিঙ্গদের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি এবং তা নিশ্চিত করতে পরিমার্জিত নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ে তৃতীয় লিঙ্গদের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনো-সামাজিক পরিবর্তনের বিষয় সংযুক্ত করা হবে।
সহপাঠীরা যেন তৃতীয় লিঙ্গদের প্রতি সহনশীল ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করে সে লক্ষ্যেও কার্যক্রমও হাতে নেওয়া হবে। পরিচালনা করা হবে প্রকল্পভিত্তিক শিখন কার্যক্রম।
নতুন শিক্ষাক্রমে যেকোনও লিঙ্গ পরিচয়বহনকারী শিক্ষার্থীরা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাবে। তাদের লেখাপড়ার স্বাভাবিক পরিবেশও নিশ্চিত করবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, ‘অটিস্টিক শিশু ও তৃতীয় লিঙ্গদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে কারিকুলামে ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার প্রতি সহপাঠীদের সহনশীল আচরণ প্রয়োজন সবার আগে। তৃতীয় লিঙ্গদের নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা তৈরিরও ব্যবস্থা থাকবে। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে তাদের বিষয় যুক্ত করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্পভিত্তিক শিখন ব্যবস্থাও হাতে নেওয়া হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, আগে তৃতীয় লিঙ্গদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে বাধা না থাকলেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল না। ফলে শিক্ষার্থী যখন বুঝতে পারতো সে তৃতীয় লিঙ্গ তখন সামাজিক বাধার কারণেই স্কুল থেকে ঝরে পড়তো। তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় জানাজানি হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পেতো না ভর্তির সুযোগ।
তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, যদি একজন ছেলে হিসেবে শিক্ষা শুরু করে এক পর্যায়ে নিজের পরিচয় নারীতে পরিবর্তন করতে চায় তাহলে সেটার যেন সুব্যবস্থা থাকে।
এ বিষয়ে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক কে এম এনামুল হক বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে বাধা ছিল না। কিন্তু যখন তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় সবাই জানে, তখন সে বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। তাই সামাজিক বাধা দূর করতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গদের আত্তীকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভর্তির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও থাকতে হবে। কোনও প্রতিষ্ঠান ভর্তি না করাতে চাইলে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে এই উদ্যোগ কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।’
ড. মশিউজ্জামান বলেন, ‘জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ধারণা প্রয়োজন। তৃতীয় লিঙ্গরাও যে আমাদের মতো মানুষ, তারাও যে সমান সম্মান ও অধিকার ভোগ করবে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এটা বোঝানো প্রয়োজন।’
সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গ শিক্ষার্থীদের জন্য চার স্তরে উপবৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাথমিকে প্রত্যেককে মাসে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিকে ৮০০ ও উচ্চ মাধ্যমিকে ১০০০ টাকা করে এবং উচ্চতর শিক্ষায় ১ হাজার ২০০ টাকা হারে উপবৃত্তি দেওয়া হয়।
এদিকে, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা পরামর্শ দিচ্ছেন, যদি একজন ছেলে হিসেবে শিক্ষা শুরু করে এক পর্যায়ে নিজের পরিচয় নারীতে পরিবর্তন করতে চায় তাহলে সেটার যেন সুব্যবস্থা থাকে।
তৃতীয় লিঙ্গদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠন ‘সম্পর্কের নয়া সেতু’র সভাপতি জয়া শিকদার বলছেন, পুরুষ হিসেবে পড়ালেখা করার কারণে তার সার্টিফিকেট থাকে পুরুষের নামে। পরে রূপান্তরিত হওয়ার পর এই পরিচয় তাকে সব ক্ষেত্রে বেশি ভোগায়।
“১৮ বছর বয়সের পর যদি কেউ মনে করে আমার শরীর পুরুষের কিন্তু আমি নারী। সে নারীর পোশাক পরতে পারে, সার্জারির মাধ্যমে নারী থেকে পুরুষ বা পুরুষ থেকে নারী হতে পারে। কিম্বা কিছু নাও করতে পারে।”
“বিষয়টা তার মনস্তাত্ত্বিক। তখন তার এই রূপান্তরের প্রক্রিয়া যাতে সহজ হয়। যাতে করে তার মেডিকেল কোন পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করতে না হয়। সরকারি সব ডকুমেন্টে তার পছন্দের পরিচয়টা থাকতে হবে। তাহলে রাষ্ট্রের সব সুযোগ সুবিধা সে ভোগ করতে পারবে,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, ২০২২ সাল থেকে নতুন শিক্ষা-পদ্ধতিতে তারা পরীক্ষামূলক ভাবে পাঠ্যসূচী চালু করার ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছেন।
পরবর্তীকালে এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো যোগ হতে পারে। সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়। তারা ২০১৯ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র তৃতীয় লিঙ্গে পরিচয় দিতে পারেন, একই সঙ্গে ভোট দেয়ার অধিকার পান।
এখন নতুন এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথমবারের মত তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করতে পারবে তারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অনেক দেশেই বেশ আগে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য সবরকম সুযোগ সুবিধা চালু হয়েছে। মূলত দেশের ধর্মীয় উগ্রতা, মানুষের প্রচলিত ধ্যান ধারণার সংকীর্ণতা দেশে তৃতীয় লিঙ্গদের স্বাভাবিক চোখে না দেখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে।
বাংলাদেশের ধর্মীয় বিধিনিষেধ তুলে তৃতীয় লিঙ্গদের সবস্থানে সমান অধিকার দিতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলেও এখন এর সুষ্ঠু প্রয়োগ দ্রুত নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/১৩১৭
আপনার মতামত জানানঃ