শাকিল মাহমুদ
কয়েকদিন আগে তামিল এক সিনেমা দেখছিলাম। যেখানে একটি গ্রামের কৃষকদের সংগ্রামের চিত্র ফুটিয়ে তোলা যাচ্ছে। সে গ্রামের কৃষকরা পানির অভাবে চাষবাস করতে পারছে না৷ অথচ পানির ব্যবস্থা না করে সেখানে বহুজাতিক কোম্পানিকে গ্রামের জমি দিয়ে দেয়া হচ্ছে কারখানা করার জন্য। এ নিয়ে গ্রামবাসী একজনের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলে। অবশ্য সে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রামবাসী কোনো আক্রমনাত্মক ভূমিকা পালন না করেই দাবি আদায় করতে নামে৷ কিন্তু সে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আদতে শান্তিপূর্ণ ছিল না। কেননা, গ্রামবাসীকে নেতৃত্ব যে লোকটা দিচ্ছিলেন তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং মারধর করে। গ্রামবাসী তাদের নেতাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য পুলিশের কাছে আকুতি মিনতি করে। কিন্তু পুলিশ সাফ জানিয়ে দেয় জমি দিলেই তাদের নেতাকে ছেড়ে দিবে! শেষমেশ গ্রামবাসী রাজি হয় জমি দিতে। এই শর্তে পুলিশ নেতাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু নেতাকে পেয়ে গ্রামবাসী আবার গোঁ ধরে; জমি দিবে না। এ অবস্থায় গ্রামের কয়েকজনকে মেরে ফেলা হয় এবং পুলিশের সহায়তায় টিপ ছাঁপ জাল করে বহুজাতিক কোম্পানি জমি নিজেদের নামে লিখিয়ে নেয়। এমতাবস্থায় গ্রামবাসী কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে মিডিয়ার শরণাপন্ন হয়। কিন্তু মিডিয়া এ বিষয়কে প্রচার করতে রাজি হয় না। তারা সরাসরি জানিয়ে দেয়, এতে তাদের চ্যানেল/পত্রিকার কোনো লাভ নেই। এরচেয়ে মন্ত্রীর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান প্রচার করলে ভালো টিআরপি পাওয়া যাবে এমনকি শোবিজ তারকাদের গরমাগরম সংবাদ পরিবেশন করা তাদের একান্ত কর্তব্য। মিডিয়া থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে ৬ জন বৃদ্ধ সিদ্ধান্ত নেন তারা আত্মহত্যা করবে, তাও স্থানীয় এক চ্যানেলে– সরাসরি। যেই ভাবনা সেই কাজ। স্থানীয় সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে ৬ জন কৃষক নিজেদের গলা কেটে আত্মাহুতি দেন৷ এরপর অবশ্য জাতীয়/আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাদের আন্দোলনের খবর প্রকাশ করা শুরু করেন৷ অবশ্য সিনেমার গোটা বিষয়টাই ছিল রাষ্ট্রের আক্রমনাত্মক ভূমিকার বিরুদ্ধে গ্রামবাসীর শান্তিপূর্ণ ও আইনী ভূমিকা। এটাও রাষ্ট্রের একটি কৌশল। জনগণকে সিনেমা মারফত জানিয়ে দেয়া, রাষ্ট্র আক্রমন করলেও জনগণের উচিত আইনী পথে লড়াই করে। রাষ্ট্রকে অক্ষত রাখা। যা হোক, উপরোক্ত সিনেমার ঘটনাক্রম আমাদের মিডিয়ার চরিত্রকে উন্মোচন করার উদ্দেশ্যেই তুলে ধরা।
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিককে রাষ্ট্র খুন করে যাচ্ছে, লাখ লাখ জনগণকে শোষণ-নিপীড়ন করছে। কিন্তু সে সবের কয়টা আমাদের মিডিয়া প্রকাশ করছে? অথচ শোবিজ তারকাদের বেবিবাম্প থেকে শুরু করে কার ব্রা-পেন্টির কত দাম, কোন নায়িকা কোন নায়কের সঙ্গে ডেটে যাচ্ছে সে সব গরমাগরম খবর পরিবেশন করে যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে।
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিককে রাষ্ট্র খুন করে যাচ্ছে, লাখ লাখ জনগণকে শোষণ-নিপীড়ন করছে। কিন্তু সে সবের কয়টা আমাদের মিডিয়া প্রকাশ করছে? অথচ শোবিজ তারকাদের বেবিবাম্প থেকে শুরু করে কার ব্রা-পেন্টির কত দাম, কোন নায়িকা কোন নায়কের সঙ্গে ডেটে যাচ্ছে সে সব গরমাগরম খবর পরিবেশন করে যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। সাম্প্রতিককালেই টলিউডে নুসরাত-নিখিল ও যশকাণ্ড নিয়ে কলকাতার মিডিয়া ছিল সরগরম। তার আঁচ ভয়াবহভাবে লেগেছিল বাংলাদেশের মিডিয়াতেও। তার রেশ এখনো কাটেনি। নুসরাতে বেবিবাম্প থেকে শুরু করে হাসপাতালে গিয়ে সন্তান প্রসব এমনকি কার কোলে চেপে সে সন্তান বাড়ি ফিরেছে এবং কার নামের সঙ্গে মিলিয়ে সন্তানের নাম রাখা হয়েছে তার আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণাত্মকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে! অথচ কিছুদিন আগেই বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনের কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ের লিফটের কাজ করতে গিয়ে এক শ্রমিক পড়ে মারা যান; যার খবর বসুন্ধরার চৌহদ্দি থেকে বাইরে বের হয়নি! গ্রামে কোন কৃষক ঋণের বোঝা নিয়ে আত্মহত্যা করছে তার খবর আমরা শহরের বাসিন্দা তো দূর ওই কৃষকের গ্রামের বাইরে যে গ্রাম আছে সে গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছায় না! অথচ আমরা রোজ শুনছি, বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। হয়তো হাতের মুঠোয় কিন্তু আমাদের কাছে পৌঁছায় পদ্মা সেতুর কয়টা পিলার দৃশ্যমান হলো, কয়টা স্প্যান বসানো হলো। কিন্তু পদ্মা সেতুর পিলার আর স্প্যানের খবর জেনে মাথাপিছু ৮৫ হাজার টাকা ঋণের দায় নিয়ে ঘোরা জনগণের কি লাভ? মাথাপিছু আয়ের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হয়, যার ছিটেফোটাও জোটে না খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকের। অথচ ঋণ তাদের শোধ করতেই হবে। শ্রেণি বিভক্ত এ রাষ্ট্রে মিডিয়া কখনোই নিরপেক্ষ নয়; কোনো কিছুই নিরপেক্ষ নয়। যেহেতু রাষ্ট্রে শোষক এবং শোষিত দৃশ্যমান এবং শোষক অর্থে ক্ষমতাশালী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের দখলে সেহেতু রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা মিডিয়া ক্ষমতাশীলদের মোসাহেবি করেই টিকে থাকে। তার উৎকৃষ্ট উদাহণ পাওয়া যা মুনিয়া এবং পরীমনির ঘটনা থেকে। মুনিয়ার সঙ্গে বসুন্ধরার এমডির প্রেম প্রণয়ের সম্পর্ক। একপর্যায়ে এমডি মহাশয় মুনিয়াকে হুমকি ধামকি দেয়। যে কারণে আত্মসম্মানবোধ ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে, মানসিক চাপে মুনিয়া আত্মহত্যা করে। যেখানে স্পষ্টত আত্মহত্যা করতে মেয়েটিকে প্ররোচিত করা হয়েছে এবং তা করেছে বসুন্ধরার এমডি। কিন্তু এ নিয়ে প্রথমে দেশের মিডিয়া নিরব ভূমিকা পালন করে। বিশেষত বসুন্ধরার এমডিকে আড়ালে রেখে স্রেফ আত্মহত্যার ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে গুটি কয়েক মানুষের প্রতিবাদী চাপে মিডিয়ায় বসুন্ধরার এমডির নাম প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে মিডিয়ায় তেমন আলোচনা হয়নি। অথচ পরীমনির ঘটনা নিয়ে মিডিয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের তথাকথিত সুশীল-সাংস্কৃতিক সমাজ সামাজিক মাধ্য থেকে শুরু করে রাজপথে এক প্রতুবাদী মূর্তিমানবের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন প্রতি নিয়ত। নিঃসন্দেহে পরীমনির সঙ্গে আইন যে আচরণ করেছ তা কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং এর বিরুদ্ধে কথা বলা সচেতন প্রত্যেক নাগরিকেরই কর্তব্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুনিয়া এবং পরীমনির ক্ষেত্রে প্রতিবাদের যে বৈষম্য তা কেনো?
একটা দেশে মিডিয়ার শক্তি অনেক। কিন্তু সে মিডিয়া যখন রাষ্ট্রের এবং শাসক শ্রেণির মোসাহেবি করা-ই যখন তাদের এথিক্স হয়ে দাঁড়ায় তখন সে শক্তির কোনো কার্যকরী ভূমিকা থাকে না। আর রাষ্ট্রের পুঁজিপতি শাসক শ্রেণির নিজেদেরই যখন মিডিয়া হাউস থাকে তখন এসব মিডিয়ার কাছে কিছু আশা করা কলা গাছের কাছে আম চাওয়া সমান কথা। তবে এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, তাহলো সাংবাদিক এবং মিডিয়ার চরিত্র ভিন্ন। মিডিয়ার মোসাহেবি চেতনা আর সাংবাদিকদের আলাদা আলাদা চেতনার তফাৎ রয়েছে। তবে নর্দমায় পরিচ্ছন্ন ফেরেশতরাও নামলে তাদের থেকে সুগন্ধ নয় দুর্গন্ধ-ই ছড়াবে। ফলে চেতনাহীন সাংবাদিকদের সঙ্গে চেতনাসম্পন্ন সাংবাদিকদের একটা মেরুকরণ করে নেয়া উচিত। এবং এথিক্সের জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে। হাউসগুলো তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যাবে তখন মোসাহেব মিডিয়া পশ্চাৎদেশে লাত্থি দিয়ে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতার কাতারে এসে দাঁড়ানেই দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন সাংবাদিকদের দায়িত্ব। কিন্তু তা না করে আত্মস্বার্থকে উর্ধ্বে তুলে মোসাহেব মিডিয়ায় পড়ে থেকে ‘আমি ভালো’ বলে মুখে ফেনা তোলার কোনো তাৎপর্য নাই। সুতরাং চেতনাসম্পন্ন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন সাংবাদিকদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবেন। কৃষক-শ্রমিক মেহেনতি জনতার পক্ষে কাজ করে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করবেন নাকি শোষকের মোসাহেবি করে প্রতিবিপ্লবী শিবিরের অন্তর্ভুক্ত হবে– এখনই সিদ্ধান্ত নিন।
শাকিল মাহমুদ, গণমাধ্যমকর্মী ও এক্টিভিস্ট
আপনার মতামত জানানঃ