বিচারের আশা করা এদেশে ঘোর অপরাধ। মামলা করতে লাগে খুঁটির জোর। খুঁটিটা আবার তুমুল রাজনৈতিক। অহরহ ধর্ষণের এই দেশে কোনওমতে মামলা হলেও, সেই মামলা প্রত্যাহার করার জন্য প্রায়শই নির্যাতনের শিকার হন ভুক্তভোগীরা। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লার দেবীদ্বারে। সেখানে ধর্ষণের মামলা প্রত্যাহার না করায় এক নারীকে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা ও কিলঘুষি মারার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়েছে।
পরিবারের অভিযোগ, ওই নারীর কিশোরী মেয়ে সম্প্রতি ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়। এ ঘটনায় আদালতে মামলা হয়েছিল। সেটি প্রত্যাহার না করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তার মাকে পিটিয়েছে প্রতিপক্ষ।
মারধরের ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে ওই নারীর স্বামী দেবীদ্বার থানায় মামলা করেন। এতে একই এলাকার আট ব্যক্তিকে আসামি করেছেন তিনি। ওই রাতেই মামলার দুই আসামি কামাল হোসেন (৫৫) ও তার স্ত্রী কুলছুম আক্তারকে (৪০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মামলার অপর আসামিরা হলেন কামালের ভাই নুরুল ইসলাম (৬৫) ও সফিকুর রহমান (৬০), একই গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে মো. কাউছার (৩৫) ও মো. হাসান (২৫), কাউছারের স্ত্রী নারগিস আক্তার (৩০) ও হাসানের স্ত্রী আনিকা বেগম (২৫)।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৪ মে বিকেলে ওই কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালান হাসান। পরদিন কিশোরীর বাবা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।
এতে ক্ষিপ্ত হয় হাসানের পরিবার। তারা গ্রামের একটি চক্রের সহযোগিতায় মামলা তুলে নিতে কিশোরীর পরিবারকে চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিতে থাকে।
গত ২০ আগস্ট দুপুরে হাসানের বড় ভাই কাউছার ওই কিশোরীর মাকে সড়কে পেয়ে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা ও কিলঘুষি মারেন। নির্যাতনের শিকার ওই নারী অচেতন হয়ে সড়কে পড়ে যান।
এ ঘটনার ৩২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও বৃহস্পতিবার ফেসবুকে প্রকাশ করেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। মুহূর্তেই সেটি ছড়িয়ে পড়ে। এতে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৩২ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, ধর্ষণচেষ্টা মামলার আসামি মো. হাসানের বড় ভাই কাউছার আহম্মেদ ওই কিশোরীর মাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে লাঠিপেটা করছে। এ সময় তাকে স্থানীয় কয়েকজন থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরে ওই কিশারীর মাকে অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
এ প্রসঙ্গে ধর্ষণচেষ্টার শিকার কিশোরীর বাবা বলেন, ‘মামলা তুলে নিতে আসামিরা প্রকাশ্যে আমার স্ত্রীকে রাস্তায় ফেলে লাঠিপেটা করেছে। কয়েকদিন আগে একইভাবে আমাকে ও আমার মেয়েকেও নির্যাতন করেছে। বিচার পেতে অনেকের কাছে গিয়েও কোনো কাজ হয়নি। আমি হতদরিদ্র মানুষ। তাই বাধ্য হয়ে থানায় এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মো.হাসান আমার মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে কুমিল্লা আদালতে একটি মামলা দায়ের করি। এরপর থেকে মামলা তুলে নিতে কিছু প্রভাবশালীর সহযোগিতায় হাসানের পরিবার আমাকে হুমকি দিতে থাকে। মামলা তুলে না নেওয়ায় আমার স্ত্রীকে প্রকোশ্যে লাঠিপেটা করে তারা।’
ভিডিও ভাইরাল হবার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে দেবীদ্বার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ওই গ্রামে যায়। তারা ওই নারীর পরিবারকে মামলা করতে বলে। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে মামলা করেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, গত ২৪ মে বিকেল ৩টার দিকে ওই কিশোরীকে একটি খালি ঘরে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় হাসান। এ ঘটনা হাসানের চাচী দেখে ফেললে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। পরে অচেতন অবস্থায় স্থানীয় লোকজন এসে ওই কিশোরীকে ঘর থেকে উদ্ধার করেন। পরদিন ওই কিশোরীর বাবা কুমিল্লা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি ধর্ষণচেষ্টার মামলা দায়ের করেন।
এতে ক্ষিপ্ত হয় হাসানের পরিবার। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর সহযোগিতায় মামলা তুলে নিতে ওই কিশোরীর পরিবারকে চাপ প্রয়োগসহ বিভিন্ন হুমকি দিতে থাকে তারা। পরে গত ২০ আগস্ট দুপুরে হাসানের বড় ভাই কাউছার ওই কিশোরীর মাকে রাস্তায় পেয়ে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা করে। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যান।
তবে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ধর্ষণচেষ্টা মামলার আসামি হাসান। তিনি বলেন, ওই কিশোরীর পরিবারের সঙ্গে তাদের জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হয়। পরে আদালতে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়।
তারা ওই মামলা তুলে নিতে বলেছিলেন। তা শোনেনি কিশোরীর পরিবার। কিশোরীর মায়ের ওপর হামলার কথা স্বীকার করে হাসান বলেন, মামলা প্রত্যাহার না করায় ক্ষোভ থেকে তার বড় ভাই কাউছার ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন।
দেবীদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান বলেন, পুলিশ দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলা হওয়ার পর থেকে অন্য আসামিরা পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে করোনাকালে অর্থাৎ গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতনের ঊর্ধ্বগতি উদ্বেগজনক। সংরক্ষিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মতো বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৪৫১। চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ১৭৯৪টি। এ হিসাবে বৃদ্ধির হার প্রায় ২৪ শতাংশ।
ধারণা করা হয়, এর বাইরেও অসংখ্য ঘটনা আছে নির্যাতন ও ধর্ষণের যা আলোর মুখ দেখেনি। এদেশের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীর ভোগান্তি, থানায় মামলা করা থেকে পুলিশ এবং প্রভাবশালীদের নিপীড়ন, মামলা তোলার চাপ সমাজে বিচারহীনতায় সাক্ষর বহন করে। এর ফলে ঘৃণ্য এই অপরাধ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪১৩
আপনার মতামত জানানঃ