কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় প্রায় ২০ ঘণ্টা ধরে আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছেন ১৫ বাংলাদেশি নাগরিক। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন তারা। এই মুহূর্তে কাবুল বিমানবন্দরে হামলার আশঙ্কার মধ্যে কতটা নিরাপদে থাকবেন তারা, এটাই বড় প্রশ্নের।
চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের ১৬০ জন আফগান শিক্ষার্থীর আজ বৃহস্পতিবার একটি বিশেষ ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসার কথা। সেই ফ্লাইটেই দেশে ফেরার কথা আফগানিস্তানে আটকে পড়া এই ১৫ বাংলাদেশির।
বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) এই বিশেষ ফ্লাইটটির আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসার কথা। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় তারা প্রায় ২০ ঘণ্টা ধরে কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছেন। বিশেষ ফ্লাইটটির সরাসরি চট্টগ্রামে অবতরণ করার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের ১৬০ শিক্ষার্থী আফগানিস্তানে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। তালেবান দেশটির ক্ষমতা দখলের পর তারা আটকে পড়েন।
দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকা বাংলাদেশের ১৫ নাগরিকের একজন হচ্ছেন রাজীব বিন ইসলাম। তিনি পেশায় প্রকৌশলী, কাজ করতেন আফগান ওয়্যারলেসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে।
রাজীব বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমে বলেন, ‘গত মঙ্গলবার আমাদের দেশের উদ্দেশে যাত্রার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে কাবুল বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করেও মাঝপথে ফিরতে হয়েছিল। পরে বিমানবন্দরে এসে জানি, আজ আমাদের জন্য ক্লিয়ারেন্স রয়েছে।’
রাজীব জানান, তারা স্থানীয় সময় বুধবার (২৫ আগস্ট) দুপুর ২ টা থেকে কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে অবস্থান করছেন। বিমানবন্দরে ঢোকার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষায় আছেন তারা। জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশেষ ফ্লাইটে তাদের দেশে ফেরার কথা।
এর আগে, গত রোববার আফগানিস্তানে আটকে পড়া ২৯ বাংলাদেশির মধ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে কর্মরত ফারুক হোসেন ও মহিউদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ সি-১৭-এর একটি ফ্লাইটে কাবুল থেকে কাতারে যান। একই দিনে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তিন কর্মকর্তাকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কাবুল থেকে কাজাখস্তানের রাজধানী নুর সুলতানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
১৫ আগস্ট তালেবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি আফগানিস্তানের লোকজনও দেশ ছাড়ছেন। কিন্তু ফ্লাইট না থাকায় অনেকেই আটকা পড়েছেন।
আফগানিস্তানে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। উজবেকিস্তানের বাংলাদেশ দূতাবাস সমদূরবর্তী মিশন হিসেবে আফগানিস্তানে কাজ করে থাকে। উজবেকিস্তানে বাংলাদেশের দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে ২৯ জন বাংলাদেশির আটকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। যদিও সংখ্যাটি ২৬ নাকি ২৯, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তাদের মধ্যে ৫ জন ইতোমধ্যে আফগানিস্তান ত্যাগ করেছেন।
আফগানিস্তানে কী অবস্থায় আছে বাংলাদেশিরা?
প্রসঙ্গত, উজবেকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জাহাঙ্গীর আলম ‘সমদূরবর্তী রাষ্ট্রদূত’ হিসেবে উজবেকিস্তানের পাশপাশি আফগানিস্তান, কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের দায়িত্ব পালন করছেন। গত ২০ আগস্ট প্রকাশিত ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আজকে পর্যন্ত বাংলাদেশি আছেন ২৬ জন। তাদের অবস্থা বলতে গেলে আমি বলব, তারা ভালো আছেন এবং তারা নিরাপদে আছেন।
তিনি বলেন, তাবলীগ জামাতে ছয়জন আছেন। তারা আছেন জালালাবাদ শহরে। উনারা আমাদেরকে মেসেজ দিয়েছেন। ব্র্যাকের যে ছয়জন আছেন, তারা একটা রেস্ট হাউসে আছেন, নিরাপদে আছেন কিন্তু তাদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।
আবার ওখানে একটা টেলিকম কোম্পানি আছে, সেখানে সাতজন কাজ করছেন। তারাও নিরাপদে আছেন। দুইজন কাজ করেন, ডিপলোমেটিক ক্যারিয়ার, কাবুলের ওয়াযির আকবর খানের ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড সেনিটেশন এন্ড সুয়ারেজে। তারা বলছেন যে, এত বেশি সুনসান নীরবতা, যা তাদের অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তারা বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশে যেতে চাই, মান্যবর রাষ্ট্রদূত আমাদেরকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।”
মাজার-ই-শরীফে একজন আছেন, তিনি অর্থ কষ্টে ভুগছেন। কাবুল থেকে ৪৩০ কিলোমিটার দূরে মাজার-ই-শরীফ, আপনি জানেন এটা উজবেকিস্তানের বর্ডারের কাছাকাছি।
আবার একজন আছেন যিনি জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তালিবান কাবুলে ঢোকার পরপরই সেন্ট্রাল জেলটা ওপেন করে দেয়, যার ফলে আমাদের একজন বাংলাদেশি বেরিয়ে আসেন। আসার পর উনি এক জায়গায় শেল্টার নিয়েছেন, কিন্তু উনি আবার অর্থ কষ্টে ভুগছেন। উনি হয়তো অত আতঙ্কগ্রস্ত নন কিন্তু অর্থ কষ্টে ভুগছেন। আমরা অ্যাম্বেসি থেকে চেষ্টা করেছি অন্যদের সহায়তায় তাদের অর্থ কষ্ট লাঘব করার জন্য।
তিনি জানান, অনেকেই আমাদের হট লাইনে যোগাযোগ করছেন। আমি আজকেও জানতে পারলাম যে তাদের একজনের ভিসার মেয়াদটা নেই। এখন আফগানিস্তানে যেহেতু কোন রাজনৈতিক সরকার নেই এবং তাদের যে নরমাল অফিসিয়াল ফাংশন, সেটা তেমনভাবে হচ্ছে না এবং হয়তো বন্ধ হয়ে আছে, সে জন্য আমার কাছে, অ্যাম্বাসেডরের স্বাক্ষরিত একটা চিঠি উনি চাচ্ছেন এবং তার সাথে মনে হয় আরো কয়েকজন থাকতে পারে।
আরও কয়েকজন আছেন যাদের পাসপোর্টের মেয়াদ চলে গেছে। তারা একটু ভয়ের মধ্যে আছেন। তারা বারবার বলছেন, “আমরা কোথায় যাব? কিভাবে কি করব?” আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করেছি যে, এখানে ভয় ভীতির কোন কারণ নেই। আমি প্রয়োজনে দরকার হলে তাদের ট্রাভেল পাস ইস্যু করবো। আপনারা বাংলাদেশের নাগরিক, আপনাদের বৈধতা আছে। বৈধ নাগরিককে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি সর্বোতভাবে চেষ্টা করবে। যদি কোন তালিবান সংশ্লিষ্টতা না থাকে, অন্য কোন অসৎ বা অন্য কোন বিপথগামীতার যদি প্রমান না থাকে এবং যদি ভ্যালিড ডকুমেন্টস থাকে তবে অবশ্যই আপনাদের আতঙ্কের কোন কারণ নেই, ভয়ের কোন কারণ নেই। আপনারা বাংলাদেশে যেতে পারবেন। এটা আমি তাদেরকে নিশ্চিত করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দু’জন বাংলাদেশি আছেন যারা একটা জার্মান-বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানিতে কাজ করেন। জার্মানী ওখান থেকে স্পেশাল ফ্লাইট পাঠাচ্ছে তাদের কর্মচারী এবং জার্মান নাগরিকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের সাথে উজবেকিস্তান গভর্নমেন্টের একটা সমঝোতা হয়েছে যে, তারা উজবেকিস্তানের তাসখন্দ এয়ারপোর্টটাকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করবে। আমাদের ওই দুইজন বাংলাদেশি সুযোগটা গ্রহন করছেন, যেহেতু তারা ঐ কোম্পানিতে চাকরি করেন।
আফগানিস্তান থেকে সবাইকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে মো জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এখন হামিদ কারজাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে কমার্শিয়াল ফ্লাইট স্থগিত হয়ে আছে। এ কারণে এখন কোনো কমার্শিয়াল ফ্লাইট যাতায়াত করছে না। এবং আমার মনে হচ্ছে— এই ইভ্যাকুয়েশন (মানুষকে সরিয়ে নেওয়া) যদি সম্পন্ন হয়ে যায়, তাহলে আবার কমার্শিয়াল ফ্লাইট চালু হয়ে যাবে। তখন আমাদের বাংলাদেশিরা চলে যেতে পারবেন।’
‘তারপরও আমি তাদের (বাংলাদেশিদের) বলেছি, যদি কোনো দেশের বিশেষ ফ্লাইট আসে, যদি সেখানে তাদের কোনো সুযোগ থাকে বা তারা যদি তা আমাদের অর্থাৎ দূতাবাসকে জানাতে পারেন যে, এই ফ্লাইটে সুযোগ আছে, তাহলে আমি সেই দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলে তাদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব। আমি সেটা তাদের আশ্বস্ত করেছি।’
‘আমাদের তরফ থেকে সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় যোগাযোগ করেছি আমরা। এখন অন্য দেশেরও যদি কোনো স্পেশাল ফ্লাইট আসে, তাহলে আমরাও দূতাবাস থেকে চেষ্টা করছি তাদের জানিয়ে দিতে, তারা যেন ওই ফ্লাইটে যেতে পারেন। এবং তাদেরও বলা হয়েছে যে, যদি আপনাদের কাছে মনে হয়, এই ফ্লাইট আপনাদের নিতে পারে, আপনার কোনো সহকর্মীকেআ নিচ্ছে, সে দিক থেকেও আপনারা যোগাযোগ করতে পারেন। এখানেও আমরা চেষ্টা করছি। এ সব বিবেচনা করে আমার বিশ্বাস— আমরা বাংলাদেশিদের সরিয়ে নিতে পারব, বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিতে পারব।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা এখনও নিরাপদে থাকলেও, তালিবানের দখলদারিত্বে বিদেশি সেনাদের দেশটিতে থাকার সময়সীমার মধ্যে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব না হলে পরিস্থিতি কতটা নিরাপদ থাকবে বলা মুশকিল। তবে আশ্চর্যের বিষয় দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সরিয়ে আনতে সরকার নিজের উদ্যোগে কোনো ফ্লাইটের ব্যবস্থা রাখেনি। এখানেও ভরশা করা হচ্ছে অন্যান্য দেশের ফ্লাইটের উপর। তাই দেশটিতে বাংলাদেশিদের নিরাপত্তার ইস্যুতেও প্রশ্ন উঠছে সরকারের প্রতি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ