দেশে প্রতি ৬ মিনিটে একজনের মৃত্যু হচ্ছে করোনায়। ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে মোট ১৩ লাখ ৯ হাজার ৯১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে মারা গেছেন ২১ হাজার ৬৩৮ জন; এদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বয়স পঞ্চশোর্ধ্ব। মৃত্যুর মিছিল থামাতে, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি ব্যাপক ভিত্তিক টিকাদানের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের যথেষ্ট টিকা আছে এই বক্তব্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, মিথ্যা আশ্বাস আর একের পর এক পরিকল্পনাহীন সিদ্ধান্ত। বিশেষ গণটিকাদান কার্যক্রম, ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুত টিকাদান, ৭ দিনে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার ঘোষণার গালভরা গল্পের এই উৎসবে চলমান মহামারিতে দেশের সার্বিক টিকাদান কর্মসূচির অবস্থা অনেকটা তলা ছেঁড়া বস্তার মতো।
‘পর্যাপ্ত টিকা’ এবং দশকের সবচেয়ে বড় গুজব
পর্যাপ্ত টিকা আছে দেশে; সাম্প্রতিক সময়ে এর থেকে বড় মিথ্যা আর বলা হয়নি। যেখানে করোনা প্রতিরোধে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া প্রয়োজন। সেখানে ১ কোটি টিকা মজুদ রেখেই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাথে জড়িতরা গলা উঁচু করে প্রচার করছে ‘পর্যাপ্ত টিকা’র এক আষাঢ়ে গল্প। করোনা মহামারি প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে এই মিথ্যের প্রশ্রয় টিকাদানে সৃষ্টি করেছে নতুন জটিলতা। নিবন্ধন করেও টিকার তারিখ জানিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাচ্ছে না মানুষ। এরপর ক্ষুদে বার্তা পেলেও আবার টিকা গ্রহণের তারিখ পাচ্ছেন দুই সপ্তাহের ব্যবধানে। তাই সরকারের ‘পর্যাপ্ত টিকা’ যে এই দশকের সবথেকে বড় গুজোব, তা নিয়ে সন্দেহ থাকে না।
দেশে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। দেশে এ পর্যন্ত টিকা এসেছে ২ কোটি ৫৫ লাখ ৪৩ হাজার ৭২০ ডোজ। সূত্র মতে, এরমধ্যে এক কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা সরকারের কেনা। বাকিটা উপহারের। দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর এখন পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৪৪ লাখ ২৬ হাজার ৮৪ ডোজ। এর মধ্যে এক ডোজ নিয়েছেন ১ কোটি ৯ হাজার ৯৫৩ জন। টিকার দুই ডোজ নিয়েছেন ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ১৩১ জন। এগুলো দেওয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীনের তৈরি সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার ভ্যাকসিন।
৩ আগস্ট পর্যন্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৫৩ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৫ জন। মোট দেয়া হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৫১ হাজার ৪১৫ ডোজ। ৩২ লাখ ৩ হাজার ৫২৭ ডোজ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে এখন পর্যন্ত। মডার্নার টিকা এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ ১৫ হাজার ৫১১ ডোজ। ফাইজার দেয়া হয়েছে ৫৫ হাজার ৬৩১ ডোজ।
টিকা দেয়ার শুরু থেকে এখন অব্দি সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে। অথচ মাত্র ১ কোটি ৪৪ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়েছে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কোনো দেশের জনগোষ্ঠীর অন্তত ৮০ শতাংশকে টিকা নিতে হবে। দেশের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনতে ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮ হাজার মানুষকে টিকা দিতে হবে। সেজন্য দুই ডোজের টিকার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ২৭ কোটি ৪ লাখ ১ হাজার ৬০০ ডোজ। তবে এক ডোজ টিকার ক্ষেত্রে কিছু কম প্রয়োজন হবে। সরকার জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের টিকা ৭ কোটি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেক্ষেত্রে মোট টিকার প্রয়োজন হতে পারে ২০ কোটি ৪ লাখ ১ হাজার ৬০০ ডোজ।
দেশে এখন পর্যন্ত শতকরা তিন ভাগ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি সংসদে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেয়ার কথার পাশাপাশি একটি রোডম্যাপও ঘোষণা করেন। যেখানে প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার কথা বলা হয়। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ। তবে বাস্তবে এই জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি হবে। সেই হিসাব ধরলে ১৭ কোটি জনসংখ্যার ৮০ ভাগ হলো প্রায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ। এখন এই এই জনগোষ্ঠীর ২৫ লাখকে যদি প্রতিমাসে টিকা দেয়া হয় তাহলে সবাইকে টিকা দিতে সাড়ে চার বছরেরও বেশি সময় লাগবে।
এখানেও গালভরা কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তার মতে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশের মানুষের জন্য ২১ কোটি টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামী বছরের শুরুর মধ্যে দেশে চায়নার ৩ কোটি, ৩ কোটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা, কোভ্যাক্সের ৭ কোটি, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি ১ কোটি এবং জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির ৭ কোটি টিকা পর্যায়ক্রমে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। তবে এটা কতটা সত্য, তা টিকা হাতে না পাওয়া অব্দি বলা যাচ্ছে না।
ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার
এদিকে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে টিকা নিয়ে নিবন্ধ করা মানুষের সংখ্যা। গত ৩০ জুন টিকার নিবন্ধন কার্যক্রম দ্বিতীয় দফায় উন্মুক্ত করে সরকার। জানা গেছে, গত ৩০ জুন থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৬২ লাখ ২২ হাজার ২৯৮ জন টিকাপ্রত্যাশী নিবন্ধন করেছেন। ৩ আগস্ট পর্যন্ত মোট নিবন্ধন করেছেন প্রায় ১ কোটি ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫ জন মানুষ। যাদের প্রায় ৭০ শতাংশ টিকা পেয়েছে; যার মধ্যে দুই ডোজ টিকা পেয়েছে ৫৫ শতাংশ।
বর্তমানে টিকার মজুদ আছে ১ কোটি ১১ লাখ ১৭ হাজার ৬৩৬ ডোজ। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা মজুদ আছে ১৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৫ ডোজ। সিনোফার্ম মজুত আছে ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩৭ ডোজ। ফাইজার মজুদ আছে ৪৪ হাজার ৯৮৯ ডোজ। মডার্না আছে ৪৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৯ ডোজ।
দ্বিতীয় ডোজের টিকা হাতে রাখলে মজুদ টিকার বিপরীতে টিকার জন্য নিবন্ধিতদের সংখ্যা হিসেবে আনুমানিক মাত্র ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হবে। অথচ আকাশ কুসুম কল্পনায় ব্যস্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিলেন এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এমনকি টিকা ছাড়া রাস্তায় বের হওয়া অপরাধ বলে গণ্য করা হবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়; যা পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়। এ অবস্থায় গ্রামে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও, সেখানে ব্যাপক হারে টিকা দেয়া সম্ভব হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর উপর আবার টিকার স্বল্পতার কারণে সরকার গতকাল রাতে টিকাদান কর্মসূচির সময়সীমা ছয় দিন থেকে কমিয়ে এক দিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
টিকার স্বল্পতার কারণে ৭ থেকে ১২ আগস্টের টিকাদান কর্মসূচির সময়সীমা কমিয়ে আনা হয়। আপাতত টিকা দেওয়ার ব্যাপক উদ্যোগটি শুধুমাত্র ৭ আগস্ট (শনিবার) পরিচালিত হবে। প্রাক-নিবন্ধনের ভিত্তিতে প্রতিটি কেন্দ্রে ৩০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বয়স্ক, নারী ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। দেশে চার হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৩২৮টি পৌরসভা ও ১২টি সিটি করপোরেশন আছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নে তিনটি করে টিকাদান বুথ থাকবে এবং শুধুমাত্র এই কেন্দ্রগুলো থেকেই টিকা দেওয়া হবে।
মূলত বছরের শুরুতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা কার্যক্রম শুরু হলেও বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছিল। পরে সরকারি প্রচারণা, বিভিন্ন দেশে টিকা প্রয়োগের খবর পাওয়া ও বয়সের সীমা কমানোর কারণে নিবন্ধন বৃদ্ধি পায়। তবে নিবন্ধনের হার বাড়লেও টিকা পাওয়ার হার সে তুলনায় বাড়েনি। অর্থাৎ এখন মানুষের মধ্যে টিকা নেয়ার আগ্রহ তৈরি হলেও দৈনিক সক্ষমতা অনুযায়ী টিকা দিতে পারছে না স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
সরকারের হিসাব বলছে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে গণপরিসরে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ দিনে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬৮ ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে মডার্না, সিনোফার্ম ও ফাইজারের টিকা গণপরিসরে প্রয়োগ করছে সরকার। ১ জুলাই থেকে রাজধানীর সাত কেন্দ্রে ফাইজার, ১২ জুলাই থেকে জেলা ও উপজেলায় সিনোফার্ম এবং ১৩ জুলাই থেকে সিটি করপোরেশন এলাকায় মডার্নার টিকা প্রয়োগ চলছে। এর আগে সিনোফার্ম প্রয়োগ করা হলেও তা গণপরিসরে হয়নি। গণপরিসরে প্রয়োগ শুরুর পর ১০ দিনে এ তিন টিকার ১৭ লাখ ৯০ হাজার ৬৩৯ ডোজ প্রয়োগ করা হয়, যা ফেব্রুয়ারির চেয়ে মাত্র ১৩ শতাংশ বেশি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৫৮
আপনার মতামত জানানঃ