ধীরে ধীরে প্রতি সেক্টরে বিচরণ বাড়ছে ট্রান্সজেন্ডারদের। এবার অলিম্পিকের ১২৫ বছরের মধ্যে প্রথম ঘোষিত ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে মূল আসরে অংশগ্রহণ করে ইতিহাস গড়লেন নিউজিল্যান্ডের ভারোত্তোলক লর্যেল হাবার্ড। গতকাল সোমবার (২ আগস্ট) বিকালে অন্য নয় জন প্রতিযোগীর সঙ্গে টোকিওতে নারীদের ৮৭+ কেজির ওজন শ্রেণির ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
রূপান্তরিত নারী হাবার্ড সাধারণত সাক্ষাৎকার দিতে চান না। তবে গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিকে (আইওসি) ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অলিম্পিক গেমসকে আমাদের আশা, আদর্শ এবং মূল্যবোধের বৈশ্বিক উদযাপন হিসেবে দেখছি এবং খেলাধুলাকে সবার জন্য উন্মুক্ত ও সহজলভ্য করার প্রতিশ্রুতির জন্য আমি আইওসিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
হাবার্ড চূড়ান্ত পর্বে তিনবারের চেষ্টাতে তিনবারই ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে কোন পদক ছাড়াই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে তাকে। ভারোত্তলনের এই বিভাগে স্বর্ণ জিতেছে চীনের লি ওয়েনওয়েন।
২০১৩ সালে নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে চিহ্নিত করার আগে পুরুষ এককের ভারোত্তোলনে অংশগ্রহণ করেছেন হারবার্ড।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বর্তমান আইন অনুযায়ী, যে সকল ক্রীড়াবিদ পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হয়ে আইওসির অধীনে খেলায় অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করে, তাদের প্রমাণ করতে হয় যে, তারা তাদের টেস্টোস্টেরনের (পুরুষত্বের জন্য দায়ী প্রধান স্টেরয়েড হরমোন) মাত্রা প্রতি লিটারে ১০ ন্যানোমোলের নিচে নামিয়ে এনেছে এবং একইসঙ্গে প্রতিযোগিতার ১২ মাস আগে থেকেই তারা সেই মাত্রা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
সেদিক বিবেচনায় ২০১৫ সাল থেকেই অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন হাবার্ড। তবে আইওসির দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করা সত্ত্বেও হাবার্ডের অংশগ্রহণ একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে থাকছে।
ট্রান্স ক্রীড়াবিদরা তাদের প্রতিযোগিতায় অনিবার্যভাবে আধিপত্য বিস্তার করে থাকেন বলে সমালোচকদের তরফ থেকে প্রায়ই অভিযোগ এসে থাকে। কিছু সমালোচক অবশ্য যুক্তি দিয়ে বলে থাকেন যে, ১০ ন্যানোমোলের মাত্রা নির্ধারণ করা যথার্থ নয় কারণ, বেশিরভাগ নারী ক্রীড়াবিদ সচরাচর এক থেকে পাঁচ ন্যানোমোলের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা (প্রতি লিটারে) নিবন্ধন করে থাকে। তবে কেউ কেউ অনুপাতের এ মাত্রা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেও প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার পূর্বে মাত্রা বজায় রাখার সময়সীমা এক থেকে দুই বছর কিংবা তার অধিক বাড়ানোর পক্ষপাতী।
অলিম্পিকে হাবার্ডের অন্তর্ভুক্তিতে বেশ বিতর্ক হয়েছে। হাবার্ডের ভক্তরা প্রথম থেকেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে এসেছে। কেননা এই সিদ্ধান্তের ফলে অন্য ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলেটরাও খেলায় অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা পাবে। তবে সমালোচকরা বরাবরই নারী অ্যাথলেটদের বিপক্ষে ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলেটদের প্রতিযোগিতা অন্যায্য হিসেবে দাবি করে এসেছে।
আইওসির চিকিৎসা ও বৈজ্ঞানিক পরিচালক রিচার্ড বাজেট এ ব্যাপারে আরো গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘পুরুষ বয়ঃসন্ধির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর তাদের (ট্রান্স নারীদের) খেলায় অধিক সুবিধা আদায়ের বিষয়টা নিয়ে এই মুহূর্তে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা চলছে, কিন্তু রুপান্তরের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে তাদের অন্যান্য সমস্ত অসুবিধার কথাও আমাদের ভাবতে হবে।’
‘জৈবিক যৌনতা’-এর প্রস্তাবিত বৈশিষ্ট্যগুলি, যেমন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ও হাড়ের ঘনত্ব, এখন অব্দি পরিষ্কার নয়। এ ক্ষেত্রে বাজেট আরও বলেছেন, ‘অভিজাত প্রদর্শনীর বিকাশে অবদান রাখতে শারীরবৃত্তীয় অনেকগুলো দিক রয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে মানসিক দিকটাও কত অবদান রাখতে পারে তা বলা খুব কঠিন। তবে হ্যাঁ, পুরুষ বয়সন্ধির মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে তার (হাবার্ড) একটি সুবিধা থাকতেও পারে।’
‘কিন্তু পুরো ব্যাপারটা মোটেও সহজ নয়। আমার মতে, ক্রীড়াবিভাগগুলো প্রতিটি নির্দিষ্ট খেলাধুলার শারীরিক মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব নিয়মনীতির মূল্যায়ন করতে পারে, যেন তারা সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও প্রত্যেক খেলোয়াড়ের (নারী, পুরুষ বা ট্রান্স) অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারে।’
অলিম্পিক গেমস প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসা হাবার্ডের সাহস ও দৃঢ়তার প্রতি শ্রদ্ধাও জানিয়েছেন বাজেট।
৪৩ বছর বয়সী রূপান্তরিত নারী হাবার্ড ১৯৯৮ সালে পুরুষদের ১০৫+ কেজি ভারোত্তোলনে নিউজিল্যান্ডের জুনিয়র রেকর্ড ভেঙে সবার নজর কেড়েছিলেন। ২০১২ সালে রুপান্তর প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর তিনি ২০১৭ সালে সর্বপ্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। পরের বছর ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নেওয়ার সময় হাত ভেঙে ফেলেন তিনি। তবে এদিন অলিম্পিকের ইতিহাসে প্রথম প্রকাশ্যে খেলতে নামা ট্রান্স নারী হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে তার।
টোকিওতে এবারের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে এলজিবিটিকিউ+ অন্তর্ভুক্ত কমপক্ষে ১৭৯ জন সমকামী, উভয়কামী, ট্রান্সজেন্ডার, কুইয়ার এবং নন-বাইনারি ক্রীড়াবিদ অংশগ্রহণ করছেন, যা ২০১৬ রিও অলিম্পিক গেমসের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। উল্লেখ্য, ২০০০ এথেন্স অলিম্পিকে সর্বপ্রথম ট্রান্সজেন্ডার খেলোয়াড়দের অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
অলিম্পিকে হাবার্ড প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী অ্যাথলেট হলেও প্রথম ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলেট কিন্তু নন। অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী প্রথম ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলেট হচ্ছেন কানাডিয়ান ফুটবলার কুইন। এবারের আসরেই কানাডিয়ান দলের সাথে অলিম্পিকে আসা কুইন বাড়ি ফিরছেন একটি মেডেল নিয়েও। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে নারী ফুটবলের ফাইনালে উঠেছে তার দল।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১২৫২
আপনার মতামত জানানঃ