চার বছরের বেশি সময় ধরে জোরপূর্বক বিতাড়িত ১১ লাখের বেশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন এই রোহিঙ্গারা গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের। ও এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। গড়ে উঠেছে সশস্ত্র সংগঠন। আল-ইয়াকিন কিংবা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মতো উগ্রবাদী সংগঠনের আতঙ্কে কাঁপছে গোটা কক্সবাজার। পাশাপাশি সস্তা শ্রমের বিনিময়ে শ্রম বাজার দখল করে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। বিপাকে সাধারণ মানুষ। গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। এর ফলে নিরাপত্তার ঝুঁকি তো তৈরি হচ্ছেই, তার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় শ্রমবাজার।
ভুয়া কার্ডের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা
সূত্র মতে, রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখন অটোরিকশা আর সিএনজির চালক। কেউ আবার জেলে। মাছ ধরে, বেচা-কেনাও করে। রোহিঙ্গাদের বিচরণ ক্যাম্পের বাইরেও এখন সর্বত্র, স্বাভাবিক।
‘রোহিঙ্গাদের শনাক্তে কার্ড করেছে সরকার। কিন্তু ভুয়া কার্ড দেখার তো কেউ নেই। ভুয়া কার্ডে ওদের ঠাটবাট (জাঁকজমক) চলাফেরা! সিএনজির ৭০ শতাংশ যাত্রীই রোহিঙ্গা। ওরা টেকনাফ, উখিয়া থেকে ওঠে। কক্সবাজারেও আসে। পথে চেকপোস্টে আটকায়, কার্ড দেখালেই ছেড়ে দেয়। কিন্তু সে কার্ড আসল না নকল, তা খতিয়ে দেখার কেউ নেই, নেই কোনো পদ্ধতিও’— কক্সবাজারের সিএনজি চালক সৈয়দ আলম।
টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমেদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তাদের কারণে (রোহিঙ্গা) স্থানীয়রাই এখন বিপাকে। ওরা যখন প্রথম আসে, মানবেতর জীবনযাপন শুরু করে তখন আমরাই (স্থানীয়রা) এগিয়ে আসি, সাহায্য-সহযোগিতা করি। যদিও আমরা ভবিষ্যতের শঙ্কায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।’
‘তাদের (রোহিঙ্গা) তো ক্যাম্পের বাইরে আসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ঠিকই তারা বাইরে বের হচ্ছে, নানা কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আজ আমরা রোহিঙ্গাদের কারণে বড় বিপদে আছি। পথে-ঘাটে, দোকানে-বাজারে, গাড়িতে সর্বত্রই তাদের দেখা মেলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ ঘরে ঘরে রোহিঙ্গা। তারা আমাদের স্থানীয় যুব সমাজকে ধ্বংস করেছে। কাউকে ইয়াবা দিয়ে, কাউকে নারী দিয়ে। রোহিঙ্গারা আর ফিরবে না, এটা এক রকম স্পষ্ট। শান্ত টেকনাফ আজ অশান্ত-বিশৃঙ্খল হয়েছে রোহিঙ্গাদের কারণে। শৃঙ্খলা ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই স্থানীয় প্রশাসনের।’
‘আমাদের অনুরোধ, টেকনাফবাসীর জন্য কিছু করুক প্রশাসন। যাতে আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারি। তা না হলে টেকনাফ কেন, এক সময় পুরো কক্সবাজার চলে যাবে রোহিঙ্গাদের কবজায়।’
সুলতান আহমেদের দাবি, ‘এক কার্ড দিয়ে অর্ধশতাধিক নকল কার্ড তৈরি করছে রোহিঙ্গারা। সেই কার্ড দিয়ে তারা নির্বিঘ্নে ঘুরছে। কিন্তু স্থানীয় হলেও আমাদের সবখানে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। সস্তা শ্রম দিয়ে শুধু টেকনাফ নয়, পুরো কক্সবাজারের শ্রমবাজার ধরে ফেলেছে রোহিঙ্গারা। এ সুযোগও নিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। মাসিক চার/পাঁচ হাজার টাকায় ওরা কাজ করে। যেখানে একদিনে স্থানীয়দের দিতে হয় ৫০০ টাকা। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের কাজের পথও রুদ্ধ করা হয়েছে।’
দেশের সর্বত্র আটক হচ্ছে রোহিঙ্গারা
রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মৌলভীবাজার শহরে আসা ১৪ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে শুক্রবার (২ জুলাই) রাতে শহরের চোবড়া এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেন মৌলভীবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েছি কোনোভাবে তারা উখিয়া শরণার্থী ক্যাম্প থেকে বের হয়ে এসেছে। এরপর কয়েকদিন চট্রগ্রামে অবস্থান করে কাজের সন্ধান চালিয়েছেন। সেখানে মানুষ তাদের কাজ পাওয়ার জন্য সিলেটের দিকে আসার জন্য বলেছে। সে জন্য তারা মৌলভীবাজার আসেন। এখানে তারা দুইদিন পূর্বে এসেছিল।
এর আগে রোববার (২৭ জুন) ভোরে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর জৈষ্ঠপুরা ও করলডেঙ্গা পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তারা কাজ করার উদ্দেশ্যে টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বোয়ালখালীতে এসেছিল বলে জানা যায়।
বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল করিম বলেন, কক্সবাজার জেলার টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ৩১ জন পুরুষ রোহিঙ্গা চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে চলে এসেছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে জৈষ্ঠপুরা ও করলডেঙ্গা এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা কাজ করার জন্য বোয়ালখালীতে এসেছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।
ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা ১৪ জন রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আটক করে জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ। মঙ্গলবার (২২ জুন) তাদের আটক করা হয়। জোরারগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) হেলাল উদ্দিন ফারুকী বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আটক ১৪ জনের মধ্যে ৪ জন পুরুষ, ৪ জন মহিলা ও ৬ জন শিশু রয়েছেন।
তিনি বলেন, আটক রোহিঙ্গারা নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে ট্রলার রিজার্ভ করে মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক জোন এলাকায় এসে নামেন। সেখান থেকে তাদের টেকনাফের কুতুবপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার কথা ছিল। পরে স্থানীয়দের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে তাদের আটক করে থানায় আনা হয়েছে। তারা কার সহযোগিতায় ভাসানচর থেকে পালিয়েছেন তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাস্তবতা এড়াচ্ছে পুলিশ
রোহিঙ্গাদের সর্বত্র বিচরণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তাদের (রোহিঙ্গা) তো ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেউ যদি বাইরে আসে, আর আমরা যদি খবর পাই তাহলে তাদের আবার ধরে ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেব।’
অপহরণ ও মানবপাচারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানবপাচারের মতো ঘটনায় পুলিশ অভিযোগ পেলেই খতিয়ে দেখছে। অপহরণের ঘটনা যাচাই-সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক আল-ইয়াকিন কিংবা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মতো উগ্রবাদী সংগঠনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। তারপরও আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/৯৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ