ম্যারিনা এস্টার্কে
কলম্বিয়ার চলমান বিক্ষোভে পুলিশি সহিংসতার স্বরূপ মানচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছিল দেশটির সংবাদমাধ্যম সেরোসেতেন্তা। এ জন্য তারা জোট বেঁধেছিল সাংবাদিক ও গবেষকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন বেলিংক্যাট এবং গবেষণা সংস্থা ফরেনসিক আর্কিটেকচারের সঙ্গে। মানচিত্র তৈরি হয়েছে। এখন দ্বিতীয় ধাপে তারা প্রকৃত ঘটনাকে পুনর্নির্মাণ করতে যাচ্ছে। দেখতে চাচ্ছে, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে সেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল।
কলম্বিয়ায়, ইভান দুকি সরকারের প্রস্তাবিত কর সংস্কার নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় গত ২৮ এপ্রিল থেকে। নাগরিকদের কাছ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর প্রস্তাবিত আইনটি আর অনুমোদন দেয়নি দেশটির নির্বাহী বিভাগ। কিন্তু বৈষম্য কমানো, পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার এবং শান্তিপ্রক্রিয়ার কার্যকর বাস্তবায়নসহ অন্যান্য দাবিতে বিক্ষোভ চলতে থাকে।
ইন্ডিপাজ ও টেম্বরোরেস ওএনজির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে দেশটিতে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৯ জনই প্রাণ হারিয়েছেন পুলিশের হাতে। প্রতিবেদনটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর আরও অনেক সীমা লঙ্ঘনের কথাও উঠে আসে। যেমন, ১৩৩টি ঘটনায় গুলি ছোড়া এবং কোনো অভিযোগ ছাড়াই ১,০৫৫ জনকে আটক করা। এ ছাড়া শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৩৬২ জন।
২৮ এপ্রিল বিক্ষোভে পুলিশি সহিংসতার চিহ্ন যখন প্রথম সামনে আসতে শুরু করে, তখন থেকেই একজোট হয়ে কাজ শুরু করে সেরোসেতেন্তা, বেলিংক্যাট ও ফরেনসিক আর্কিটেকচার।
এই প্রকল্পের সমন্বয়ক ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন সেরোসেতেন্তার সহ-প্রতিষ্ঠাতা লোরেঞ্জো মোরালেস। ল্যাটঅ্যাম জার্নালিজম রিভিউকে (এলজেআর) তিনি বলেছেন, “সেই মুহূর্ত থেকেই আমরা পুরো দল নেমে পড়ি ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের কাজে।”
এই যৌথ উদ্যোগে প্রথম ধাপের কাজ ছিল একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ মানচিত্র তৈরি। ৯ মে এটি প্রকাশিত হয় এই শিরোনামে: কলম্বিয়ার রাস্তায় নিপীড়ন ও মৃত্যু। এর মাধ্যমে তাঁরা পুলিশি সহিংসতার অনেক ভিডিও এক জায়গায় দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন দর্শকদের। ভিডিওগুলো সাজানো হয়েছে তারিখ ও ভৌগোলিক অবস্থান (জিও-লোকেশন) ধরে। ফলে আলাদা করে দেখা যায়, নির্দিষ্ট দিনে শহরের কোথায় কোথায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে, দেশজুড়ে যত সহিংসতার ঘটনা দেখা গেছে, তা-ও একবারে, এক জায়গায় দেখতে পাওয়া সম্ভব এই মানচিত্রভিত্তিক ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রতিবেদনে। মানচিত্রকেন্দ্রিক এই ডেটাবেস বানানোর জন্য যেসব ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর সবই এসেছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। এগুলো বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পোস্ট করা হয়েছিল। তবে সেগুলো ডেটাবেসে যোগ করার আগে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কঠোর মানদণ্ড অনুসরণ করে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিক্ষোভের ২২ দিনে পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় ২৯ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এই কাজের জন্য যে ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি সরবরাহ করেছিল ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনভিত্তিক ফরেনসিক আর্কিটেকচার।
এত দ্রুত সময়ের মধ্যে ম্যাপটি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে; কারণ, তিনটি সংগঠনই এর আগে অন্য প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করেছে। যেমন, ২০১৯ সালে সেরোসেতেন্তা ও বেলিংক্যাট একটি বিক্ষোভ নিয়ে যৌথভাবে অনুসন্ধান করেছিল। সেই বিশেষ প্রতিবেদনে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল বোগাটার বিক্ষোভে ১৮ বছর বয়সী ডিলান ক্রুজের মৃত্যুর ঘটনা। মাথায় বিন ব্যাগ আকৃতির প্রজেক্টাইলের (কম প্রাণঘাতী গুলি, বিবি নামেও পরিচিত) আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
সেরোসেতেন্তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছেন বেলিংক্যাটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ও অপরাধবিজ্ঞানী জিয়ানকার্লো ফিওরেলা। এলজেআরকে তিনি বলেছেন, “আমি একদিন একটি ফোন পাই সেরোসেতেন্তা লরেঞ্জোর কাছ থেকে: ‘হাই জিয়ানকার্লো, আপনি হয়তো আমাকে চেনেন না। কিন্তু আমরা বেলিংক্যাটের ব্যাপারে শুনেছি। আপনাদের কাজ সম্পর্কে আমরা ভালো জানি। আমাদের কাছে এই বিক্ষোভের অনেক ভিডিও আছে। এবং আমরা ভাবছিলাম, আপনারা হয়তো এই ভিডিওগুলো দেখার ব্যাপারে আগ্রহী হবেন এবং আরও ভিডিও খুঁজে বের করতে চাইবেন। হয়তো এভাবে আমরা খুঁজে বের করতে পারব: ডিলান ক্রুজকে কে হত্যা করেছিল।”
ঘটনার দিন সেখানে ধারণ করা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা অনেক ভিডিও পর্যালোচনা করে তাঁরা সত্যিই শেষ পর্যন্ত শনাক্ত করতে পেরেছিলেন: কোন পুলিশ কর্মকর্তা এই গুলি চালানোর জন্য দায়ী।
ফিওরেলা বলেছেন, “প্রচুর ভিডিও সংগ্রহ করার জন্য সেরোসেতেন্তা সত্যিই মাঠপর্যায়ে অনেক ভালো কাজ করেছে। এবং তারা আসলে এই ভিডিওগুলো দেখেছেও লম্বা সময় ধরে। তারপর সেগুলো একের পর এক দৃশ্য ধরে মিলিয়েছে এবং পুলিশ কর্মকর্তাকে শনাক্ত করেছে।”
মোরালেস জানিয়েছেন, এই অনুসন্ধানের প্রমাণাদি ব্যবহার করে বেসামরিক আদালতেও বিচার চাইতে গিয়েছিল ভিকটিমের পরিবার। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মামলাটি এখনো সামরিক আদালতেই আটকে আছে। এবং সেই কর্মকর্তা এখনো যুক্ত আছেন পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে।
২০১৯ সালের এই সাফল্যের পর, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরেও আবার একজোট হয়ে কাজ করে দুই সংগঠন। তখন কলম্বিয়ায় আরেকটি বিক্ষোভ শুরু হয়। এবার তারা প্রকাশ করে একটি বিশেষ সিরিজ, দ্য ডার্ক নাইট অব #৯এস। ৩০০টির বেশি ভিডিও ও মাঠপর্যায়ের রিপোর্টিং ব্যবহার করে এতে পুনর্নির্মাণ করা হয় ৯ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনাগুলো, যেখানে ১০ জন বেসামরিক ব্যক্তি মারা গিয়েছিল।
এই কাজের সময়ই সেরোসেতেন্তার সঙ্গে ফরেনসিক আর্কিটেকচারের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল বেলিংক্যাট। ফরেনসিক আর্কিটেকচার তাদের একটি ম্যাপ বানাতে সাহায্য করে, যেখানে সব অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রমাণ থাকবে। ২০২০ সালে প্ল্যাটফর্মটি প্রথম ব্যবহার করা হয়। এবং সাম্প্রতিক বিক্ষোভেও এটি নতুন করে কাজে লাগানো হয়েছে।
দ্রুতই, তারা ম্যাপে বিভিন্ন ধরনের সার্চ-টুল যুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। যেমন, একটি টাইমলাইন, যেখানে বিভিন্ন সময়ের (২০২০ ও ২০২১) ডেটা ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে দেখা যাবে। সহিংস আচরণ (মৃত্যু, আহত, গাড়ি চাপা) ও ভিকটিমের ধরন (বেসামরিক ব্যক্তি, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী) অনুযায়ীও সার্চ করার ব্যবস্থা যুক্ত করতে চেয়েছে তারা।
কাজের পদ্ধতি ও ভিডিওর সত্যতা যাচাই
সব কটি অনুসন্ধানেই গবেষণা করা হয়েছে ওপেন সোর্স পদ্ধতিতে, যা শুরু হয় ইন্টারনেটে সবার জন্য উন্মুক্ত অবস্থায় থাকা তথ্যগুলো দিয়ে। সেটি হতে পারে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পাওয়া কিছু বিক্ষোভের ভিডিও বা সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া নথিপত্র। বেলিংক্যাট বিশেষভাবে এই জায়গাটিতে কাজের জন্যই সুখ্যাতি কুড়িয়েছে। নাগরিক অনুসন্ধানীদের এই জোট গড়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডে, এবং এখন তারা কাজ করে নেদারল্যান্ডস থেকে।
ভেনেজুয়েলার বংশোদ্ভূত ফিওরেলা এখন থাকেন কানাডায়। তিনি জানিয়েছেন, শুধু সেরোসেতেন্তা নয়, বিশ্বের অন্যান্য সংবাদমাধ্যমকেও বেলিংক্যাট সহায়তা করেছে তাদের গবেষণাপদ্ধতি শিখিয়ে। এর মাধ্যমে ভিডিও যাচাইয়ের কৌশলসহ সাংবাদিকেরা অনেক বিষয়ে দিকনির্দেশনা পেতে পারেন।
ফিওরেলা ব্যাখ্যা করে বলেন, “ধরুন, একজন টুইটারে একটি ছবি পোস্ট করে বলল: ‘আমি ভিডিওটি আজ সকালেই করেছি, বোগোটায়।’ তাহলে কি সত্যিই সেটি সেই সকালেরই ছবি? এবং সেটি কি বোগোটাতেই তোলা হয়েছে?”
এই কাজের পুরো প্রক্রিয়াকে নির্মাণকাজের রূপক দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন মোরালেস। প্রথম ধাপটিকে তিনি তুলনা করেছেন “বুলডোজার দিয়ে খননের” সঙ্গে। এই ধাপে আপনি ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম থেকে পাওয়া যত বেশি সম্ভব ভিডিও, ছবি ও বক্তব্য সংগ্রহ করবেন।
“এই ধাপে আপনি এমন হাজারো ধরনের তথ্য সংগ্রহ করবেন। সে যা-ই হোক। হয়তো কিছু জিনিসের পুনরাবৃত্তিও দেখা যাবে, যাদের কোনো কিছুই যাচাই করে দেখা হয়নি,” বলেছেন মোরালেস।
দ্বিতীয় ধাপের কাজটি নির্মাণশিল্পীদের। যেখানে তারা “বুলডোজার” পাশে সরিয়ে “পিক্যাক্সের” মতো আরও সূক্ষ্ম ধরনের টুল হাতে নেন। এই পর্যায়ে সবকিছু ডেটাবেসে যোগ করা হয় এবং তারিখ, স্থান ইত্যাদি ক্যাটাগরি অনুসারে সাজানো হয়। ভিডিওগুলোর বর্ণনা ও তাদের আদি উৎস যোগ করা হয়।
মোরালেস ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “এই পর্যায় থেকেই আমরা তথ্যগুলো পরিষ্কারভাবে সাজানো এবং মিথ্যা ও অপ্রাসঙ্গিক সব ভিডিও বাদ দেওয়া শুরু করি। কখনো কখনো চিলি, বলিভিয়াতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাও ঘুরতে থাকে কলম্বিয়ার ঘটনা বলে। আমার মনে আছে, একবার দেখেছিলাম: ভারতের একটি ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছিল কলম্বিয়ার কেস হিসেবে। বা এমন আরও অনেক কিছু থাকে, যেগুলো সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয় না। যেমন কখনো কখনো দেখা যায়, ভিডিওতে কেউ মাস্ক পরা অবস্থায় নেই। তখন সেটি দেখেই বলে দেওয়া যায় যে, এগুলো হয়তো এই সময়ের নয়।”
এই পর্যায়েই, তথ্যগুলো এভাবে যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেলিংক্যাটের গবেষণাপদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা বেশ ভালোভাবে এসে পড়ে। এই কাজে প্রথম ধাপ হচ্ছে: গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনে রিভার্স ইমেজ সার্চ চালানো।
ফিওরেলা বলেছেন, “এর মাধ্যমে আসলে আপনি প্ল্যাটফর্মগুলোর কাছে জানতে চাইছেন যে: তোমরা কী জানো, ইন্টারনেটে এই ভিডিও আগে থেকেই আছে কি না? এখান থেকে আপনি জানতে পারবেন: কোনো পুরোনো ভিডিও নতুন করে প্রচার করা হচ্ছে কি না।”
আরেকটি যাচাই করার মতো বিষয় হলো: জিও-লোকেশন বা ভূ-অবস্থান। যেখানে রিপোর্টার বা গবেষকেরা গুগল স্ট্রিট ভিউ ব্যবহার করে খুঁজে দেখতে পারেন যে আসলেই ভিডিওটি কোথায় ধারণ করা হয়েছিল। সে জন্য তাঁরা দেখেন আশপাশের ভবন, বিভিন্ন চিহ্ন, রাস্তার নাম ইত্যাদি। গুগল ইমেজ অনেক সময় হালনাগাদ অবস্থায় না-ও থাকতে পারে। ফলে যেসব বৈশিষ্ট্য বেশি স্থায়ী, সেগুলোর দিকে নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
“যেমন, আপনি হয়তো রাস্তার ক্ষেত্রে ভালো করে দেখতে চাইবেন যে, হাইওয়েটিতে কতগুলো লেন আছে? রাস্তার পাশে কী ল্যাম্পপোস্ট আছে? থাকলে কতগুলো? কারণ, এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনেক স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোতে খুব বেশি পরিবর্তন আসার কথা নয়,” বলেছেন ফিওরেলা। এই পদ্ধতিতে কোনো জায়গা শনাক্ত করার কাজটিতে কয়েক ঘণ্টা বা কখনো কয়েক দিনও সময় লাগতে পারে।
তৃতীয় ধাপটি হলো: ভিডিওটি কোন সময়ে ধারণ করা হয়েছে, তা নির্ধারণ করা। কলম্বিয়ার বিক্ষোভের ক্ষেত্রে, সময় নির্ধারণ করতে গিয়ে একই ঘটনার অন্য সব ভিডিওকে পাশাপাশি রেখে সেগুলোর মধ্যে একটি সময়ের ধারাবাহিকতা তৈরি করা হয়েছিল।
ফিওরেলা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “এগুলো সত্যিই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে ওঠে। অনেক মানুষ এসব বিক্ষোভে অংশ নেয়, যাদের অনেকের কাছেই সেলফোন থাকে, এবং তারা রেকর্ড করে। আপনি যদি একই ঘটনার এমন আরও অনেক ভিডিও খুঁজে বের করতে পারেন, তাহলে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজালে কোন সময় কোন ঘটনা ঘটেছে, তার একটি ধারণা পেয়ে যাবেন।
এ ছাড়া একই ঘটনার অন্যান্য নথিপত্রের দিকেও খেয়াল করেন গবেষকেরা। এটি হতে পারে ঘটনাটি নিয়ে অন্য মানুষজনের কথাবার্তা, বা অন্যান্য প্রতিবেদন, যেগুলো কোনো বক্তব্য-ভাষ্যকে সমর্থন জোগায়। এভাবে যাচাই-বাছাই শেষে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো: এই সব ভিডিও, আর্কাইভ বা ভালোভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ, এগুলো হতে পারে খুবই সহিংস ঘটনার চিত্র, বা সেখানে হয়তো পুলিশের কোনো অপরাধের কথা উঠে এসেছে। ফলে অনেক মানুষই হয়তো সেসব পোস্ট পরে মুছে দেবে; বা এমনকি সেই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মও তাদের নীতিমালা ভঙ্গের জন্য ভিডিওটি মুছে দিতে পারে।
ফিওরেলা বলেছেন, “কখনো কখনো মানুষ ঘটনার উত্তেজনার মধ্যে অনেক কিছু শেয়ার করে। কিন্তু পরবর্তীকালে উপলব্ধি করে: ‘এটি শেয়ারের জন্য আমি হয়তো ঝামেলায় পড়তে পারি।’”
এই অপরাধবিজ্ঞানীর মতে, যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি খুবই মূলগত/মৌলিক একটি কাজ। কারণ, এটিই ঠিক করে দেয় যে, একটি ভিডিও প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কি না।
তিনি বলেছেন, “একটি ভিডিও কখন ও কোথায় ধারণ করা হয়েছিল, তা খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারলে সেটিতে অনেক প্রমাণযোগ্য হয়। কারণ, তখন সরকার, পুলিশ বিভাগ বা ক্ষমতাবান মানুষেরা এটি বলতে পারে না যে, ‘এটি তো আসলে ঘটেনি, এটি ফেক নিউজ’। তখন আপনি বলতে পারেন যে ‘না, এটি সত্যি ঘটনা। এবং সেই রাতেরই ঘটনা। আমি এটি প্রমাণ করতে পারব।’ এটি প্রমাণ-যোগ্যতা তৈরি করে। ফলে ক্ষমতায় থাকা মানুষদের পক্ষে এই সত্য অস্বীকার করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।”
শেষ পর্যায়ের কাজটিকে মোরালেস তুলনা করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের সঙ্গে। যেখানে ছোট একটি “ব্রাশ নিয়ে তারা আস্তে-ধীরে পরিষ্কার” ও বিশ্লেষণ করেন কোনো জিনিসকে। এই পর্যায়ে ভিডিওগুলো একসঙ্গে জুড়ে একটি ধারাবাহিকতা তৈরি করতে হয়, এবং কীভাবে ধীরে ধীরে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে থাকে। এই রকম পর্যায়েই তারা অপরাধ ও অন্যান্য ঘটনার চিত্র নতুন করে তৈরি করেন। যেমনটা করা হয়েছিল ডিলান ক্রুজের প্রতিবেদনটির সময়। এখন সেই দলই কয়েকটি ছোট দলে ভাগ হয়ে একই রকম কাজ করছে সমসাময়িক ঘটনাগুলো নিয়ে। যেগুলোর মধ্যে একটি ছিল বিক্ষোভে মারা যাওয়া তরুণ লুকাস ভিয়ার ঘটনা।
তখনকার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির পার্থক্য হলো: এখনকার বিক্ষোভে অনেক বেশি মৃত্যু দেখা যাচ্ছে। আরও বিপুল পরিমাণ তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, এবার পুলিশি সহিংসতা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু বোগাটা বা তার আশপাশে সীমাবদ্ধ নেই। যেমনটি ২০২০ সালে ছিল। “এবার আরও নিয়মিতভাবে দেখা যাচ্ছে নিপীড়নের অনেক চিত্র,” বলেন মোরালেস।
কোনো অপরাধবিষয়ক অনুসন্ধানের শেষ অংশটিতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু তথ্যের স্পষ্টতা তৈরির ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মোরালেস বলেছেন, “আমাদের কাছে বাঁধভাঙা বন্যার মতো তথ্য আসে। আমাদের এমন অনুভূতি হয় যে, আমরা সবকিছু দেখে ফেলেছি। কিন্তু গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায়, আমরা আসলে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। এখানেই আসে উপলব্ধিগত পর্যায়টি: সত্যিই কী ঘটেছিল, কীভাবে ঘটেছিল, কে গুলি চালিয়েছিল, কে দায়ী।”
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে ডিজিটাল অনুসন্ধানের কলাকৌশলের সঙ্গে প্রথাগত সাংবাদিকতার মিশেল ঘটানো খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন কলম্বিয়ার এই সাংবাদিক। মাঠপর্যায়ে যেতে হবে; ঘটনাস্থলে থাকে কিংবা কাজ করে—এমন মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে; ইন্টারনেটে বা অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি—এমন ছবি-ভিডিও আছে কি না, তা-ও খোঁজ করতে হবে।
এ রকম একটি অনুসন্ধানের সময়, সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া ভিডিও থেকে রিপোর্টাররা বুঝতে পেরেছিলেন: ঠিক কোন জায়গায় মানুষটিকে হত্যা করা হয়েছে। তারপর, সেখানে সশরীরে গিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছিল একটি বাড়তি ভিডিও। সেখানকার একটি ফলের দোকানে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার সেই ভিডিও ফুটেজটি পরবর্তী সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
একইভাবে, দ্য ডার্ক নাইট অব #৯এস প্রতিবেদনটির অনুসন্ধানের জন্য, তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে এমন এক ব্যক্তির খোঁজ পেয়েছিলেন, যিনি কিছু গুলির খোসা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। এই গুলিগুলো চালিয়েছিলেন হুড পরা কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি। ডিলান ক্রুজের ঘটনার সময়ও, তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে এ রকম গুলির খোসা খুঁজে পেয়েছিলেন, যেগুলো একই পুলিশ কর্মকর্তার বন্দুক থেকে ছোড়া হয়েছিল।
“আমরা সব সময়ই দুটি ধারার সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছি। আমরা এমন কোনো নিউজরুম হয়ে উঠতে চাইনি, যারা শুধু ডিজিটাল জগতেই কাজ করে… বরং আমরা এটিকে মেলাতে চেয়েছি মাঠপর্যায়ের কাজের সঙ্গে। এটিই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে; বিশেষ করে একটি ঘটনার ফরেনসিক পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে,” বলেন মোরালেস।
এই প্রকল্প, বিশেষভাবে এই মানচিত্র মোরালেস ও ফিওরেলার জন্য বেশ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটি কাজ করবে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে। কারণ, এটিই একমাত্র টুল, যা বিক্ষোভ বা আন্দোলনের সময় সাধারণ মানুষের ধারণ করা ভিডিওগুলো সংগ্রহ ও যাচাই করে এবং বিভাগ অনুযায়ী সাজিয়ে রাখে। এবং এটির একটি যথাযথ গবেষণাপদ্ধতি আছে। এ কারণে, তাদের আশা: এই প্ল্যাটফর্ম গবেষক, অপরাধবিজ্ঞানী ও সাংবাদিকদের জন্য একটি উপকারী ডেটাবেস হিসেবে কাজ করবে।
তাঁরা বলছেন, সব ধরনের আক্রমণ ও নিপীড়নের ঘটনা এক জায়গায় দেখতে পাওয়ারও একটি সুবিধা আছে। আলাদাভাবে একেকটি ঘটনা কাভার করলে সেগুলো মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায়।
মোরালেস বলেছেন, “সবকিছু এক জায়গায় একসঙ্গে রাখার মধ্য দিয়ে এটির একটি সংরক্ষণগত মূল্য তৈরি হয়; যা দিয়ে বুঝতে পারা যায়: এই ঘটনাগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। দ্বিতীয়ত, এই সবকিছু এক জায়গায় থাকার ফলে নানাবিধ ফরেনসিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো সম্ভব হয়। এই ডেটাবেস ও ভিডিও ব্যাংক ছাড়া আমরা তৃতীয় ধাপে যেতে পারতাম না। তৃতীয়ত: আমার মনে হয়, এ রকম একটি ডেটাবেস থাকার ফলে ‘এখানে কিছুই ঘটেনি…’-এমন কথা বলে এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন ও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। আপনি যখন এই পুরো চিত্র এক জায়গায় দেখতে পাবেন, তখন দেখবেন যে: সরকার ও কর্তৃপক্ষ যেভাবে বিষয়গুলো ভুলে যেতে বলছে বা উড়িয়ে দিতে চাইছে—তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য মনে হবে না।”
প্রকল্পটির দুই সমন্বয়কই বলেছেন, ম্যাপটি এভাবে বুঝতে সাহায্য করে যে, পুলিশি সহিংসতার বিষয়টি বারবার ঘটে এবং এটি একটি কাঠামোগত বিষয়। কারণ, এগুলোর মধ্যে একটি প্যাটার্ন স্পষ্টভাবেই দেখতে পাওয়া যায়।
মোরালেস বলেছেন, “কলম্বিয়ার সরকার এসব ক্ষেত্রে এমন এক ধারণার পেছনে আশ্রয় নেয় যে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং হঠাৎ করেই কোনো পুলিশ কর্মকর্তা নিজের সীমা ছাড়িয়ে যান। কিন্তু আপনি যখন বিষয়গুলো এক জায়গায় এনে দেখা শুরু করবেন, তখন আপনি উপলব্ধি করবেন যে, শুধু কিছু কিছু কর্মকর্তা খারাপ—এমনটি নয়। সেখানে চরম মাত্রার সহিংসতা চলে।”
এটি আপনাকে সত্যিই খুব নাড়া দেবে। আপনি দেখবেন যে শুধু অল্প কিছু মানুষ খারাপ—বিষয়টি এমন নয়। এটি অল্প কিছু খারাপ মানুষের বিষয় হতে পারত। কিন্তু এই খারাপ মানুষগুলোই আছে সব জায়গায়। পুলিশি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অপব্যবহারের যে সার্বিক চিত্র, তা তুলে আনার এটি একটি পদ্ধতি,” বলেন ফিওরেলা।
কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভান দুকি সম্প্রতি এই পদ্ধতিগত পুলিশি অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস সূত্রে জানা যায়, তিনি বলেছেন, “ক্ষমতার অপব্যবহারের কিছু ঘটনা ঘটেছে।” কিন্তু “যদি বলা হয় যে, কলম্বিয়ার পুলিশ পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বা অনিয়ম করে; তাহলে সেটি হবে অন্যায্য, অযৌক্তিক ও পুরোপুরি ভিত্তিহীন।”
তিনি আরও দাবি করেছেন: এ ধরনের অনিয়মের জন্য “কোনো ছাড় দেওয়া হয় না।” এবং অন্তত ৬৫টি এমন অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে উন্মুক্ত তদন্ত হয়েছে।
ভিডিওগুলো সংগ্রহ ও যাচাইয়ের জন্য ১০ জনের একটি দল বানিয়েছিল সেরোসেতেন্তা। তাদের সঙ্গে আরও যোগ দিয়েছিলেন ১০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবী, যাঁরা ইউনিভার্সিটি অব দ্য আন্দিজের সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী। সেখান থেকেই কাজ করে সংবাদমাধ্যমটি। বিশ্ববিদ্যালয়টির জার্নালিজম স্টাডিজ সেন্টারের অধ্যাপক, ডিজাইনার, ডেটা বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও এই প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন।
মোরালেসের মতে, এই ধরনের কর্মপরিবেশের মধ্য দিয়ে দেখা যায় যে, বার্তাকক্ষ কতটা নমনীয় ও সহনশীল হতে পারে: “বিভিন্ন ধরনের মানুষের অংশগ্রহণের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার ফল হিসেবে আমরা তৈরি করেছিলাম একটি নমনীয় নিউজরুম, যেটি প্রয়োজন বুঝে ছোট-বড় করে নেওয়া যেত। কাজ করতে করতে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসেছেন, প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো দেখভালের জন্য শিক্ষকেরা এসেছেন, একটা পর্যায়ে বেলিংক্যাটের লোকেরা এসেছেন। কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বার্তাকক্ষটি আবার আগের ছোট, স্বাভাবিক অবস্থায় [৬ বা ৭ জনে] ফিরে গেছে। এই ব্যাপারটিতে আমি খুব মজা পেয়েছি। আমাদের এমন অনেক শক্তি আছে, যা জরুরি পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো যায়।”
সূত্র : Global Investigative Journalism Network
ম্যারিনা এস্টার্কে সাও পাওলো-ভিত্তিক একজন ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক। তিনি কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি ব্রাজিলিয়ান নিউজরুম, তথ্যযাচাই সংস্থা লুপা, ইউনাইটেড ন্যাশনস রেডিও, এবং স্প্যানিশ সংবাদপত্র লা ভোজ ডে গালিসিয়া। ম্যারিনা সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রী নিয়েছেন রিও ডি জেনিরোর ফেডেরাল ইউনিভার্সিটি থেকে। এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব করুনিয়ার এডিটরিয়াল জার্নালিজমে।
আপনার মতামত জানানঃ