দরিদ্র দেশের তকমা কাটিয়ে উঠতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ‘ত্রাণ না নেওয়ার’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মহামারি করোনার প্রকোপে ১৬ বছর আগে নেওয়া সেই পণ থেকে সরে আসতে হচ্ছে ভারতকে। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়ার মতো দেশ তো বটেই, সীমান্ত সংঘাত ঘিরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকা চীনের কাছ থেকেও সাহায্য নেওয়ায় আর আপত্তি নেই দিল্লির।
প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানও ইতোমধ্যেই সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও পাকিস্তানের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে সাউথ ব্লকে।
ভারতের ‘ত্রাণ না নেওয়ার’ শপথ
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সালের সুনামির পর তৎকালীন মনমোহন সিংহের সরকার বিদেশ থেকে ত্রাণ নিতে অস্বীকার করে। ২০০৫ সালে কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখাসংলগ্ন এলাকায় ভূমিকম্পে যখন ১ হাজার ৫০০ মানুষ মারা যান, তখনও বিদেশি সাহায্যের প্রস্তাব নাকচ করে দেয় ভারত।
ওই সময় পাক অধিকৃত কাশ্মীরে মৃতের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের হাতে ২ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের চেক তুলে দেওয়া হয়। পাকিস্তান যদিও সেই চেক ভাঙায়নি।
এর পর থেকে ২০০৫ সালে ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনার সময় আমেরিকা, ২০০৮ সালে সিচুয়ান ভূমিকম্পের সময় চীনসহ নেপাল, মিয়ানমার, ফিলিপাইনের মতো একাধিক সময় প্রতিবেশী দেশগুলোতে ত্রাণ পাঠালেও কারো কাছ থেকে তা গ্রহণ করেনি ভারত।
শুধুমাত্র ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে বন্যার সময় এবং ২০১৪ সালে ওড়িশায় ঘূর্ণিঝড় হুদহুদের সময় সাময়িক ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ত্রাণ না নেওয়াকে ঘিরে ২০১৮ সালে কেরালা সরকারের সঙ্গে সংঘাত দেখা দেয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদির সরকারের। সে বছর বন্যায় বিধ্বস্ত কেরলকে ৭০০ কোটি টাকার ত্রাণ দিতে চেয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু কেন্দ্রের আপত্তিতে তা কেরালা সরকারের হাতে এসে পৌঁছায়নি।
ভারতের শপথ ভাঙ্গন
তবে এ বার ১৬ বছর আগের সেই অবস্থানই বদল করছে ভারত। এর ইঙ্গিত যদিও পাওয়া গিয়েছিল গত বছরই। করোনার প্রকোপ সামাল দিতে যখন পিএম-কেয়ার্স তহবিল গড়ে তোলা হয়, তখনই দিল্লির তরফে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, যে কোনো দেশের, যে কোনো সংস্থা এবং ব্যক্তি, তাতে অনুদান দিতে পারবেন।
ভারতের ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে ভারতের সাহায্যে যেসব দেশ এগিয়ে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, রোমানিয়া, লাক্সেমবার্গ, পর্তুগাল, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, হংকং, তাইল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, নরওয়ে, ইতালি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও অনেক দেশ।
এর মধ্যে অক্সিজেনের জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভুটান। রেমডেসিভির এবং অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি মে মাসে অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি প্রতিষেধক ভারতের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথা জানিয়েছে আমেরিকা।
এদিকে আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়াসহ একাধিক দেশ থেকে সাহায্য আসতে শুরু করেছে দেশে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর দিয়ে ভারতকে সাহায্য করার কথা গতকালই জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এছাড়াও কোভিডের টেস্টিং কিট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সামগ্রী পাঠানোর কথাও জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার।
এছাড়া একাধিক অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, লাঙ্গ ভেন্টিলেটর, মনিটর, ওষুধ, করোনার আর অন্যান্য দরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল উপকরণ নিয়ে ভারতে পৌঁছায় দু’টি রাশিয়ান বিমান। অপরদিকে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর এবং দুবাই থেকে ১২টি খালি ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন কনটেনার উড়িয়ে আনল বায়ুসেনার বিমান।
এদিকে এই সব তথ্য ছাড়াও এদিন বিদেশ সচিব শ্রীংলা জানান যে এই পরিস্থিতিতে ভারতের বিভিন্ন সংস্থা চীন থেকে টিকার কাঁচামাল আমদানি করছে।
শ্রীংলা বলেন, ‘ভারতের একাধিক সংস্থা বিদেশ থেকে কাঁচামাল-সহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করে। এক্ষেত্রে অক্সিজেন জেনারেটর, কনসেনট্রেটর-সহ চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন সামগ্রী অগ্রগণ্য। এর মধ্যে বেশ কিছু চীন থেকেও আনা হয়। কিছু আবার চীনে তৈরি করানো হয়।’
চীন থেকে সাহায্য গ্রহণ
এদিকে, এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার পড়শি ভারতকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়্যাং হি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের উদ্দেশ্যে তিনি ওই চিঠি লিখেছেন। সেখানে করোনার বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন ওয়্যাং।
বিগত কয়েক বছরে চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও, সেখান থেকেও ২৫ হাজার অক্সিজেন কনসেনট্রেটর এসে পৌঁছনোর কথা। ভারতে চীনের রাষ্ট্রদূত সান উইদং সে কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘চীনের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারীরা অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন যাতে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া কমপক্ষে ২৫ হাজার অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের বরাত সময় মতো দেওয়া যায়। তার জন্য সরঞ্জাম সরবরাহকারী বিমানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দেশের শুল্ক দফতরের আধিকারিকরা এই সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সারছেন’।
চীন থেকে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আমদানি কথা স্বীকার করেছে দিল্লিও। যদিও এই আমদানিকে সাহায্য বলে মানতে নারাজ তারা। বরং কেউ যদি নিজে থেকে সাহায্য করে, তা ফেরানোর প্রশ্ন নেই বলে জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে দিল্লির এক কর্মকর্তার যুক্তি, ‘ভারত কারও কাছে সাহায্য চায়নি। এ গুলো সব টাকা দিয়ে কেনা হচ্ছে। তবে কোনো কোনো দেশের সরকার বা সেখানকার বেসরকারি সংস্থা যদি উপহার হিসেবে কিছু সাহায্য বা অনুদান দিতে চান, তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই গ্রহণ করব আমরা।’
জুলাইয়ের আগে ভারতীয় টিকা পাবে না প্রতিবেশীরা
নিজেদের অতিরিক্ত প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলংকার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিন মৈত্রী কর্মসূচি অন্তত আগামী জুলাইয়ের আগে শুরু করতে পারছে না ভারত।
করোনা মহামারির ব্যাপকতায় দেশটিতে হঠাৎ সংকট দেখা দেওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। —খবর দ্য হিন্দুর
আগামী ১ মে দেশের সবার জন্য টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার পরিকল্পনা করেছে ভারতীয় সরকার।
এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেশী দেশের জন্য মঞ্জুরিকৃত ও বাণিজ্যিক টিকা রপ্তানি স্থগিত করে দিয়েছে মোদি সরকার।
যেসব প্রতিবেশী ইতোমধ্যে অর্থ পরিশোধ করেছে, তারাও জুলাইয়ের আগে টিকা পাবে না। তাদের শেষ ব্যাচের টিকা এপ্রিলের শুরুর দিকেই পাঠানো হয়েছে।
কখন প্রতিবেশী দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ করা হবে, বৃহস্পতিবার এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারেননি ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলা।
এখন টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে খারাপ হয়ে যাবে কিনা; জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের নিজেদের প্রয়োজন অনেক বেশি। আমাদের অংশীদারদের সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের টিকাদান কর্মসূচি ২০০ থেকে ৩০০ কোটি বাড়াতে হবে।
শ্রীংলা বলেন, ভারতের প্রয়োজন খুবই বেশি। এখন যে পরিমাণ টিকা উৎপাদন করা হচ্ছে, তা নিজেদেরই লাগছে।
তবে টিকা কর্মসূচি নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংকট নিয়ে সচেতনতার কথা জানিয়েছেন ভারতীয় দুই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী তিন কোটি ডোজ কোভিশিল্ড টিকা পাঠানোর কথা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ছয় মাস ধরে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ ছয় মাসের মধ্যে সরবরাহ করার কথা। তবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে মাত্র ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে ভারত। এছাড়া উপহার হিসেবে দুই ধাপে পাঠিয়েছে আরও ৩২ লাখ। সবমিলে বাংলাদেশে আসা টিকার পরিমাণ ১ কোটি দুই লাখ ডোজ।
শ্রীলংকা এক কোটি ৫০ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড টিকার বাণিজ্যিক আদেশ দিয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ লাখ ডোজ সরবরাহ করেছে ভারত। শ্রীলংকা ও নেপালে সর্বশেষ চালান পাঠানো হয় গত ৬ ও ২৮ মার্চ। তবে সেগুলো পাঠানো হয় কোভ্যাক্স জোটের আওতায়। আর এসব দেশে বাণিজ্যিক টিকা পাঠানো বন্ধ রয়েছে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে।
ফলে ভারতের টিকা সরবরাহের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি সম্পন্ন করার চাপ ক্রমাগত বাড়ছে।
দ্য হিন্দু বলছে, ভ্যাকসিন সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় বাংলাদেশ ও নেপাল সরকার ইতোমধ্যে তাদের উদ্বেগ আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লিকে জানিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ