সেনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়া বিক্ষোভকারীরা তাদের বিক্ষোভ এখনো জারি রেখেছে। বিক্ষোভকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে দেশটির সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মিয়ানমারে জান্তাদের হুমকির পরও সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত। বরং যত দিন যাচ্ছে, বিক্ষোভ আরও জোরালো হচ্ছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত এবং অং সান সু চিসহ রাজনীতিকদের আটকের প্রতিবাদে আজ সোমবার(২২ ফেব্রুয়ারি) সাধারণ ধর্মঘট এবং রাস্তায় রাস্তায় আরও বিক্ষোভ দেখানোর ডাক দিয়েছে মিয়ানমারের অভ্যুত্থানবিরোধীরা। কর্তৃপক্ষের হুমকি এড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। এ থেকে যে কোনো সময় আরও প্রাণহানি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবারের বিক্ষোভকে দেশটির স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের দমন নিপীড়ন অব্যাহত রাখলে যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ় ব্যবস্থা নেবে এমন হুঁশিয়ারির পর এই বিক্ষোভ দেখা দিলো। সোমবার মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গনের রাস্তায় হাজার হাজার বিক্ষোভ কারী প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। আটক সকল নেতাদের মুক্তি দিন বলে তারা স্লোগান দিচ্ছেন। এছাড়া বিক্ষোভকারীরা কাউকে কর্মস্থলে না যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ইয়াঙ্গন ছাড়াও মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে বিশাল সমাবেশ দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে দেশটির মিতকিয়ানা, পানম, পিনমানাম, দাওয়েই এবং ভামোতে বিক্ষোভে নেমেছে বিক্ষোভকারীরা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, আরও সেনা মোতায়েন এবং নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মিয়ানমারের জেনারেলরা দেশটিতে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের বিরোধিতা এবং অং সান সু চিসহ আটকদের মুক্তির দাবিতে চলা বিক্ষোভ ও আইন অমান্য কর্মসূচি বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে।
অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনের পরিচিত মুখ মং সৌংখা সোমবারের বিক্ষোভে যোগ দিতে সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যাদের বাইরে আসার সাহস নেই, তারা ঘরে থাকুন। যেভাবেই হোক আমি বাইরে বের হব। আমি জেনারেশন জেডকে (চলতি শতকের দ্বিতীয় দশকে যারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে) প্রত্যাশা করছি। পার্টনাররা, চল একত্রিত হই,” রোববার রাতে ফেইসবুক পোস্টে এমনটাই লিখেছেন এ তরুণ রাজনৈতিক কর্মী।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাসের রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইয়াংগনের বাসিন্দারা। কূটনৈতিক এ মিশনগুলোও বিদেশি হস্তক্ষেপ চাওয়া বিক্ষোভকারীদের একত্রিত হওয়ার কেন্দ্র হয়ে উঠছিল।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এ দেশটিতে তারিখের মধ্যে সংখ্যাগত মিলকে ‘শুভ’ বিবেচনা করা হয়; বিক্ষোভকারীরা এ কারণে সোমবারকে (২২/২/২০২১) বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন, তারা এদিনকে ১৯৮৮ সালের ৮ অগাস্টের সঙ্গে তুলনা করছেন। সেদিনের বিক্ষোভকে সামরিক জান্তা কঠোর হস্তে দমন করেছিল, ঝরেছিল রক্ত।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বিক্ষোভ ঠেকাতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীও কম ধ্বংসাত্মক হয়নি। শনিবার গুলিতে দুই বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে বিক্ষোভে তিনজন নিহত আছেন। তবে একজন পুলিশ সদস্যও বিক্ষোভে আহত হয়ে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।
তবে শনিবার দুইজনের মৃত্যুও বিক্ষোভকারীদের পেছনে ফেরাতে পারেনি। এ দিন ইয়াঙ্গুনে যেমন তারা জড়ো হয়েছিলেন, তার চেয়ে আরও বেশি জড়ো হয়েছেন রোববার। সোমবার এরচেয়েও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছেন ওই বিক্ষোভে।
বিক্ষোভের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, স্থানীয় দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চেইনগুলোও সোমবার ঘোষণা দিয়েছে, নিজেদের ব্যবসা বন্ধ রাখবে। এরমধ্যে রয়েছে ইউম ব্র্যান্ড ইনকের কেএফসি ও ডেলিভারি হিরোর মালিকানাধীন ডেলিভারি সার্ভিস ফুডপান্ডা।
এদিকে মিয়ানমার সেনার একটি পেজ বন্ধ করে দিইয়েছে ফেসবুক। গতকাল রোববার ফেসবুকের তরফে জানানো হয়েছে, ওই পেজের মাধ্যমে সহিংসতার বার্তা ছড়ানো হচ্ছিল। সে কারণেই ওই পেজটি বন্ধ করা হয়েছে। রোববার ফের জার্মান সেনা সরকারকে আলোচনায় বসার আবেদন জানিয়েছে।
রোববার জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি জারি করে মিয়ানমারের সেনাকে বলেছে, সহিংসতা বন্ধ করে তারা যেন আলোচনার রাস্তায় আসে। গণতান্ত্রিক ভাবে যারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের তরফেও একই আবেদন জানানো হয়েছে। অন্য দিকে, বিশ্বের একাধিক দেশ ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের একাধিক সেনা জেনারেলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গণতন্ত্র ফিরে না এলে আরো বড় পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও সেনাকে জানানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘও সেনাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে সেনা ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়েছে। বন্দি করা হয়েছে অং সান সু চি সহ দেশের একাধিক নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক কর্মীকে। তারই প্রতিবাদে দেশ জুড়ে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। প্রতিবাদের নেতৃত্বে যুবসমাজ। তাদের দাবি, যে প্রক্রিয়ায় সেনা বিদ্রোহ করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়েছে, তা গণতান্ত্রিক নয়। ফলে অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মুক্তি দিতে হবে এবং পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই সেনা এই বক্তব্য মেনে নিতে রাজি নয়। গোটা দেশে বিক্ষোভের উপর সহিংস আক্রমণ চালাচ্ছে সেনা। কাঁদানে গ্যাস, জল কামান, লাঠির পাশাপাশি রবার বুলেট এবং সত্যিকারের গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। শনিবার তেমনই এক বিক্ষোভে সেনার গুলিতে দুই প্রতিবাদীর মৃত্যু হয়। আহত হন বহু।
শনিবারের বিক্ষোভে গুলি এবং ২ জন নিহতের ঘটনাও বিক্ষোভকারীদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি; পরদিন রোববার একই শহরে লাখো মানুষ সমাবেশ করেছে, আজ সোমবার এরচেয়েও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছেন ওই বিক্ষোভে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৯
আপনার মতামত জানানঃ