দুর্নীতি অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। পাসপোর্ট অফিসে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের ভোগান্তির শেষ নেই। পাসপোর্ট করাতে গিয়ে দালাল ও চক্রের খপ্পরে পড়ছে মানুষ। ফলে দালাল ও এই চক্রের সঙ্গে সম্পর্কিত অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে সাধারণ গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। এই অনিয়মই এখানে অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের তিনজন কর্মী আর বাদবাকিরা ‘দালাল’ হিসেবে পরিচিত। এরাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করে অফিসটি। চক্রটি দপ্তরের প্রধান কর্তার আশীর্বাদপুষ্ট বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই কর্মকর্তা চক্রের সদস্যদের আদর করে ‘কুড়ি জিন’ বলে ডাকেন। যাদের মাধ্যমে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাসপোর্ট অফিস এলাকায় প্রচার রয়েছে, টাকা দিলে এ জিনেরা দ্রুতগতিতে কাজ করে দিতে পারেন। নতুন পাসপোর্ট তৈরিসহ যেকোনো অফিশিয়াল কাজ করতে হলে নির্ধারিত দালালের শরণাপন্ন হতেই হবে। সরাসরি গেলে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজ হবে না। অভিযোগ, সেবাগ্রহিতারা সরাসরি গেলে তাকে মাসের পর মাস নানা অজুহাতে ঘোরানো হয়। আর দালাল চক্রের মার্কা দেয়া ফাইল গেলেই সেটা আগে জমা নেয়া হয়।
যশোর শহরের পুরাতন কাজিপাড়ার বাসিন্দার রফিক, পেশায় শ্রমিক। তিনি বলেন, আমি কাজ করি ঢাকায় বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে। তিনদিন ধরে ঘুরেও পাসপোর্টের আবেদনপত্র জমা দিতে পারেননি। কর্মকর্তারা আমাকে পেশার সার্টিফিকেট আনতে বলে। আমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করি-আজ এখানে তো কাল ওখানে। আমাকে কে সার্টিফিকেট দেবে? তিনদিন ধরে ঘুরছি। অফিসের একজন আনসার বলেছে, দুইহাজার টাকা দাও কোনো কিছু লাগবে না।
কেশবপুর উপজেলা শহরের আব্দুল আলী বণিক বার্তাকে বলেন, কাগজপত্র জমা দেয়ার পর চারবার অফিসে গেছি। গত বছরের ২৯ নভেম্বর পাসপোর্ট ডেলিভারির দিন ছিল। ডিসেম্বর-জানুয়ারি ঘুরেও পাসপোর্ট হাতে পাইনি। অথচ আমার পর বহু লোক দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করে তারা বিদেশও চলে গেছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের প্রধান গেটের সামনে ওষুধ দোকানের মালিক বাচ্চু বলেন, আমি পাসপোর্ট করতে দালালের মাধ্যমে না যাওয়ায় ছয় মাসেরও অধিক সময় ঘুরেছি। পরে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি।
শার্শা উপজেলার কালিয়ানি গ্রামের আবুল হোসের স্ত্রী সালমা বেগম, যশোর শহরের সিটি কলেজপাড়ার তহিদুল ইসলামের ছেলে হাবিবুর রহমান ও মণিরাপুরের তুশখালি দুর্বাডাঙ্গা গ্রামের সঞ্জয় মল্লিকদেরও একই রকম অভিযোগ।
অভিযোগ রয়েছে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেনের নির্দেশনা মতেই এসব অবৈধ কারবার চলছে। সে লক্ষ্যে ‘কাজে’ নিয়োজিত আছেন অফিসের উপসহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেন এবং অফিস সহকারী মোস্তফা জামান, আকমাম ও আজহারুল। আর এরাই চালান দালাল চক্রটি। দালালদের মাধ্যমে আসা টাকা-পয়সা লেনদেন ও অফিশিয়াল কাজ করে দেন তারা। তাদের নিয়ন্ত্রিত দালালরা হচ্ছেন শহরের বেজপাড়া রানার অফিস এলাকার ভজন, এমএসটিপি স্কুলগেট এলাকার স্বপন ও বিশ্বজিৎ, ছাদেক দারোগার মোড় এলাকার তাজউদ্দিন, সোনালী ব্যাংক এলাকার সোহেল ও বাবু ওরফে ঘুড়িবাবু, আদালত চত্বর এলাকার ভেন্ডার বাবু, সাইফুল ও মিজান, পাসপোর্ট অফিস এলাকার মিজান, জিরো পয়েন্ট মোড় এলাকার আনসার ও আতিয়ার, নাজিরশংকরপুর এলাকার শামিম ওরফে বেড়ে শামিম, চার খাম্বার মোড় এলাকার নিপু, রুহুল, টিটো খাঁ ও রহিম।
এ বিষয়ে দুদকের দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্র জানায়, করোনা মহামারীর কারণে অনুসন্ধান ও তদন্ত কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখন পুরোদমে সবকিছু শুরু হচ্ছে। পাসপোর্টের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। ইতোমধ্যে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ বিস্তারিত অনেক কিছুই পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, দালালের মাধ্যমে ঘুষ না দিলে পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। নিজে আবেদন জমা দিলেও কাউন্টারের লোকজন নানা সমস্যার কথা জানিয়ে দেয়। কিন্তু দালাল ধরে তাদের চাহিদার টাকা দিয়ে আবেদন করলে সময়ের আগেও পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাসপোর্ট অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাগামহীন দুর্নীতি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব করছে এবং এর ফলে প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী ক্ষতির শিকার হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখার পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রবাসী শ্রমিকরা পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রবাসী শ্রমিকসহ দেশের সাধারণ মানুষ যাতে প্রয়োজনের সময় কোনোরকম হয়রানি ও ভোগান্তি ছাড়া পাসপোর্ট পেতে পারে, সেজন্য সরকার পাসপোর্ট অধিদফতরসহ এর সব আঞ্চলিক অফিস দুর্নীতিমুক্ত করার পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৭৪৭
আপনার মতামত জানানঃ