অতীতের দিকে তাকালে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনকে রোলার কোস্টারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সময়ে সময়ে এই গ্রহের তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। একবার উষ্ণ হয়ে উঠেছে, আবার বরফযুগ শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো কখনোই স্থায়ী নয়। কিছু সময় পর পৃথিবী বর্তমানে উষ্ণ পরিবেশে ফিরে আসে। তবে নতুন এক গবেষণায় জানা যায়, আজ থেকে ১১ হাজার বছর পর পৃথিবী আবার বরফে ঢেকে যাবে।
তবে পৃথিবীর বরফযুগের কারণ নির্ধারণ সব সময় একটি কঠিন কাজ। অনেক দিন ধরে গবেষকেরা অনুমান করছিলেন, সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর বিচিত্র কক্ষপথ তুষারযুগের আগমন বা অবসানের কারণ হতে পারে।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর কক্ষপথের এমন কিছু পরিবর্তনের মধ্যে একটি স্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, যা বরফযুগের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে এখন ভবিষ্যতে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো পূর্বাভাস দেওয়ার একটি নতুন উপায় জানা গেছে। আর মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে পৃথিবী ধ্বংস না হলে ১১ হাজার বছর পর আবার বরফযুগ আসবে।
পৃথিবীর সূর্যের চারপাশে কক্ষপথ পুরোপুরি গোলাকার নয়। এটি কিছুটা এলিপ্টিকাল বা ডিম্বাকৃতির, যা ‘কক্ষপথের বৈকল্পিকতা’ নামে পরিচিত। এই কক্ষপথের বৈকল্পিকতার কারণে সূর্যটি ঠিক কেন্দ্রের মধ্যে না থেকে কিছুটা স্থানচ্যুত থাকে। এর ফলে পৃথিবীর সূর্য থেকে দূরত্ব বছরজুড়ে পরিবর্তিত হয়।
পৃথিবীর কক্ষপথের আকার এবং অবস্থান সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন প্রতি ২৬ বছরে একবার ঘটে এবং পৃথিবীর কক্ষপথের অক্ষের দিক পরিবর্তন করে। একে ‘কক্ষপথের প্রিসেশন’ বলে।
আর পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের ঢাল ‘অব্লিকুইটি’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে যে কোণে ঘোরে। পৃথিবীর অক্ষীয় ঢাল প্রায় ২৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি, যা পৃথিবীকে তার কক্ষপথের তুলনায় একটু বেঁকে থাকতে বাধ্য করে। সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী যেভাবে ঘোরে, তার সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিবর্তিত হয়।
অনেক দিন ধরে জানা গেছে, সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্কের এই বিভিন্ন গুণ তাপমাত্রার উষ্ণ ও শীতল চক্র সৃষ্টি করে। পৃথিবীর কক্ষপথের বিভিন্ন পরিবর্তন সূর্যের আলো কীভাবে পৃথিবীতে ছড়ায়, তাতে প্রভাব ফেলে। এর ফলে মৌসুমের এবং বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রায় উষ্ণতা ও শীতলতার পরিবর্তন ঘটে।
এই পরিবর্তনগুলোকে মিলানকোভিচ চক্র বলা হয় এবং এই চক্রগুলো প্রায় প্রতি ২০ হাজার, ৮০ হাজার, ১ লাখ ও ৪ লাখ বছরে ঘটে। তবে পৃথিবীর কক্ষপথের কোন কোন দিক এই জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে, তা বের করা বেশ কঠিন কাজ।
যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির পৃথিবী বিজ্ঞানী স্টিফেন বার্কার বলেন, পৃথিবীর জলবায়ু একটি জটিল–আন্তসংযোগ ব্যবস্থা, যেখানে নানা প্রক্রিয়া একসঙ্গে কাজ করে পরিবর্তনগুলো তৈরি করে। বরফযুগের চক্রের সময়সীমার মধ্যে এই পরিবর্তনগুলোর মডেল তৈরি করতে প্রচুর শক্তিশালী কম্পিউটিং শক্তির প্রয়োজন। কারণ, এই প্রক্রিয়াগুলো একে অপর থেকে পৃথকভাবে মাপা এবং এর মডেল তৈরি করা খুব কঠিন কাজ।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পৃথিবীর কক্ষপথের প্রিসেশন চক্র ২১ হাজার বছরে এবং অব্লিকুইটির দ্বিতীয় চক্র ২০ হাজার ৫০০ বছরে ঘটে। তবে এই দুই চক্রের মধ্যে কোনো সম্পর্ক বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি।
আরেকটি বিষয় হলো, গত ৮ লাখ বছরে বরফযুগের অবসান প্রতি এক লাখ বছরে ঘটছে। এর কারণও বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি।
বার্কার এবং তাঁর সহকর্মীরা গত ৮ লাখ বছরের মধ্যে গভীর সাগরের অক্সিজেন আইসোটোপের অনুপাত পরিবর্তন বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। এই তথ্য মাইক্রোস্কোপিক সামুদ্রিক প্রাণী ফরামিনিফেরা-এর ফসিলে সংরক্ষিত। এই পরিবর্তনগুলো মহাদেশীয় বরফের স্তরের বা বরফ শিটের পরিমাণের পরিবর্তন শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি পৃথিবীর অতীত বরফযুগের সম্পর্কে জানার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
এই তথ্য ব্যবহার করে বরফযুগের চক্রের একটি বিস্তারিত গ্রাফ তৈরি করেন গবেষকেরা, যেখানে তাঁরা পৃথিবীর কক্ষপথের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য—প্রিসেশন এবং অব্লিকুইটি—এর সঙ্গে তুলনা করেন। আর তখনই একটি চমকপ্রদ প্যাটার্ন উন্মোচিত হয়। গ্লেসিয়াল ও ইন্টারগ্লেসিয়াল (বরফযুগ এবং উষ্ণ সময়ে) পর্বের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো প্রিসেশন এবং অব্লিকুইটির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্কের সঙ্গে মিলে যায়। এভাবে বরফযুগের এক লাখ বছরের চক্রের প্রমাণ পান গবেষকেরা।
বিজ্ঞানী বার্কার বলেছেন, পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে দাবি করা হয়, বরফযুগের সূচনাগুলোর সময়কাল অনেকটাই এলোমেলো। তবে তাঁর দলের কাজ দেখিয়েছে, এটি আসলে নির্ধারিত। অর্থাৎ এখন আমাদের কাছে এমন একটি টুল রয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতে কখন তুষারযুগ শুরু হবে, তা পূর্বাভাস দিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অব্লিকুইটি বর্তমানে কমতে শুরু করেছে এবং এটি ১১ হাজার বছরের মধ্যে তার ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছাবে এর আগেই পরবর্তী বরফযুগ শুরু হবে।
এই গবেষণা শুধু পৃথিবীর প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় নয়। এটি মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। স্টিফেন বার্কার জানান, ‘বর্তমান সময়ে মানবজাতি গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎসমূলক থেকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে পরিবর্তন করছে।’
সম্প্রতি প্রকাশিত আইপিসিসি প্রতিবেদন অনুসারে, মানুষ এরই মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ দ্বারা জলবায়ুর প্রাকৃতিক গতিপথ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে।
এমন একটি যুগের সূচনা হতে পারে, যেখানে পৃথিবী তার স্বাভাবিক তাপমাত্রার পরিবর্তনের ছন্দ হারাতে পারে, যা ভবিষ্যতে বৃহত্তর জলবায়ু সংকট সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানী বার্কারদের নতুন গবেষণাটি ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ