দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে একসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হতো। সেই সম্পর্ক এখন টানাপোড়েনের মুখে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আর অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান না হলে এই সম্পর্ক ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া এবং বাংলাদেশের হিন্দুদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ভারতের বিরুদ্ধে ‘ঢাকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ উঠেছে। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলেছেন, উভয় পক্ষ দ্রুত কূটনৈতিক আলোচনায় না বসলে দূরত্ব আরও বাড়বে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশে এক হিন্দু পুরোহিত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জামিন না পাওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি তোলে। এ ঘটনা সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বাড়িয়ে তোলে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা এবং ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের দীর্ঘদিনের সমর্থন রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ভারত তাঁকে আশ্রয় দেওয়ায় এই অভিযোগ আরও দৃঢ় হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের এই ভূমিকাকে ‘হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাফি মো. মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘ভারতের উচিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন দেওয়া। অন্যদিকে, বাংলাদেশের উচিত সংখ্যালঘুদের সমস্যা ও অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো দ্রুত সমাধান করা, যাতে সেগুলো বাইরের কোনো শক্তির পক্ষে চাপ দেওয়ার হাতিয়ার না হয়।’
তবে এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষই আলোচনার পথে হাঁটছে না। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ভারতের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। মাহফুজ ভারতের বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় ‘ঘেঁটো তৈরি’ এবং ‘উপনিবেশ স্থাপনের’ অভিযোগ তোলেন। তিনি ১৬ ডিসেম্বর এক পোস্টে ভারতের কিছু অংশ দখলেরও হুমকি দেন। পোস্টটি পরে মুছে ফেলা হয়।
এরই মধ্যে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা কার্যক্রম সীমিত করেছে ভারত। ফলে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া বহু বাংলাদেশি বিপাকে পড়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম সংখ্যালঘু অধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের সমালোচনা করছে, যা উত্তেজনা আরও বাড়াচ্ছে। শাফি মো. মোস্তফা বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের অধিকার অবশ্যই সুরক্ষিত করা জরুরি। তবে এগুলো অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান হওয়া উচিত। বাইরের চাপ এখানে কাজে আসে না।’
যুক্তরাষ্ট্রের পিস ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ভারত এবং বাংলাদেশের আরও বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু এ জন্য দরকার শান্তিপূর্ণ আলোচনা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া।’
এই সংকট ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে নানাবিধ সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, ভারত-পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেও একই ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে কি না। দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক ভারত ভূষণ ডেকান হেরাল্ড পত্রিকায় লিখেছেন, ভারত যদি এমনভাবে চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ পুরোপুরি তার থেকে দূরে সরে যেতে পারে। ভারতের কর্মকর্তা-নেতাদের উসকানিমূলক মন্তব্য ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সহানুভূতির অভাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশে ভারতের প্রায় কোনো বন্ধুই নেই।’
দীর্ঘদিন ধরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক বিভাজন ও কাশ্মীরের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও একই পথে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা কেউ কেউ করলেও দিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের গবেষক পবন চৌরাসিয়া বলেন, ‘এটা সম্ভব নয়, কারণ বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউনূস সরকারের উচিত সংখ্যালঘুদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা এবং ভারতের উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা। ভারতও বাংলাদেশের সরকার ও তার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাবে এবং সম্ভবত এটি গোপনে চলছে।’
গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফর করেন। সে সময় তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁর ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতির জন্য আশার আলো দেখায়। তবে সংখ্যালঘু অধিকার, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে আস্থা পুনরুদ্ধারের পথ এখনো স্পষ্ট নয়।
চৌরাসিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশ কোন পথে যাবে তা নির্ধারিত হবে আগামী ছয়-সাত মাসে। সরকারের গঠন, সংবিধান পরিবর্তন এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের মতো বিষয়গুলো এখনো অস্থির। ভারতের জন্য এটি অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণের সময়।’
বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার উদ্বেগ বাড়ছে এবং ভারতের রাজনীতির শীর্ষ মহল এই পরিস্থিতি নজরদারি করছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁর প্রচারণায় বাংলাদেশের হিন্দুদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
চৌরাসিয়া বলেন, ‘মন্দির ভাঙা হয়েছে, উৎসব বন্ধ করা হয়েছে এবং অনেক হিন্দু গ্রেপ্তার বা নিহত হয়েছেন। সীমান্তের দুই পাশের মানুষের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কারণে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা এখন তাদের আত্মীয়দের জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি নিয়ে চিন্তিত।’
এখন প্রশ্ন হলো, ভারত ও বাংলাদেশ কী একে অপরের প্রতি সন্দেহ দূর করে এবং স্বার্থের দিকে মনোযোগ দিয়ে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে? তবে আপাতত এই অঞ্চলটি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আরও বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য উদ্বিগ্ন।
আপনার মতামত জানানঃ