শুধু যুক্তরাজ্য নয়, অন্য দেশেও অর্থ পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এসব অর্থ দেশে ফেরাতে প্রয়োজনে যেকোনো দেশের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
সরকার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় প্রথম একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছিল ২০১৫-১৯ সময়ের জন্য। এর নাম ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফাইন্যান্স অব টেররিজম। পরে আরেকটি কৌশলপত্র করা হয় ২০১৯-২১ সময়ের জন্য। এর পর আর কৌশলপত্র হয়নি। আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী এ কৌশলপত্র তৈরি করাটা একটা চর্চা, যা প্রায় সব দেশই করে থাকে।
কৌশলপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হওয়া শীর্ষ ১০ দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ক্যামেন আইল্যান্ড এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড। কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রসহ উন্নত কয়েকটি দেশ, যাদের ট্যাক্সহ্যাভেন বা কর ফাঁকির অভয়ারণ্য বলা হয়। এর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ আছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ড, বারমুডা, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, হংকং, জার্সি, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিদেশে পাচার হয়েছে গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা।
সংস্থাটি বলছে, তৃতীয় বিশ্বের ছোট্ট এই দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে! তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে’ যার বড় একটি অংশই পাচার হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাচার হওয়া অর্থ যেভাবেই হোক ফেরানোই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।
তারা আরও বলেছেন, গত কয়েক বছর ধরেই দেশের অর্থনীতি ডলার সংকট, ভঙ্গুর অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতিসহ নানাবিধ টানাপোড়েনে আছে, যার অন্যতম কারণ অর্থ পাচার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈশ্বিক বাণিজ্যভিত্তিক কারসাজি, হুণ্ডি, চোরাচালানসহ নানাবিধ পন্থায় পাচার করা হয়েছে লক্ষাধিক কোটি টাকা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, গেল প্রায় দেড় যুগে দেশীয় ১৯টি ব্যাংকে আত্মসাৎ করা মাত্র ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারিতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় একশ হাজার কোটিরও বেশি টাকা পাচার হয়েছে । শুধু ব্যক্তি উদ্যোগেই নয়, দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকও অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে।
বেশ কয়েক বছর আগেই পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে বহু দেশের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান সরকার সেসব চুক্তি এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ জারি রাখতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করার ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন এজেন্সি আছে। আমাদের বিদেশের সঙ্গেও বেশ কিছু নেটওয়ার্ক আছে। তাই আমাদের সেগুলোও ব্যবহার করতে হবে।
বৈশ্বিক পরিসরের উদ্যোগের পাশাপাশি অর্থ ফেরাতে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে। প্রয়োজনে টাস্কফোর্স গঠনের দ্বারা নিবিড় অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন আইনজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসাইন বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ বা পাচার করা হলে দুদকের সেটা উদ্ধার করার সক্ষমতা রয়েছে। দ্রুতই যতখানি সম্ভব অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, এ বিষয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
উল্লেখ্য, এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে দেশটির সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন।
গত ২১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ড. ইউনূস পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা চান।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জানতে পারি যে, শেখ হাসিনা সরকারের সময় বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচার হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাড়িঘর করেছেন। পাচার হওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে ফেরত আনা যায়, সে বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন ড. ইউনূস।’
তিনি বলেন, সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এনে দেশ পুনর্গঠনের কাজে লাগাতে চায়।
আপনার মতামত জানানঃ